পবিত্রতা অর্জন করার বিধান পর্ব-৩ (তায়াম্মুম করা)

 
তায়াম্মুম (১ম ভাগ)
ওযু এবং গোসলে পানি না পাওয়া গেলে বা পানি ব্যবহারে রোগ বেড়ে যাবার আশংকা থাকলে বা অসুখের কারণে পানি ব্যবহার করা সম্ভব না হলে পবিত্র মাটি বা মাটি জাতীয় দ্রব্যাদি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করাকে তায়াম্মুম বলে। যদি কেউ পানি না পায় এবং সালাত ছেড়ে যাবার আশংকা থাকে তাকে তায়াম্মুম করে সালাত আদায় করতে হবে।
তায়াম্মুম সম্বন্ধে কোরআনের বাণী
“ফালাম তাযিদু মা’আন ফাতাইয়াম্মামু সায়িদান তায়্যিবান ফামছাহু বিওযুহিকুম ওয়া আইদিকুম।”
‘যদি পানি না-ই পাও, তাহলে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করে নেবে (এবং তার পদ্ধতি হচ্ছে), তা দিয়ে তোমাদের মুখমন্ডল ও তোমাদের হাত মাসেহ করে নেবে’ {সূরা আন্ নিসা, আয়াত ৪৩}
 
তায়াম্মুম সম্বন্ধে কয়েকটি হাদীসঃ
(১) রাসূল (সা.) মাত্র একবার হাত মেরে দুহাতের বাজু ও মুখমন্ডল মুছতেন। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/৩৪০; মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/৭০৩-৭০৫} কিন্তু তিনি দু’বার হাত মেরে উভয় হাত কনুই পর্যন্ত মাসেহ করতেন বলে ইবনে মাজাহ, দারাকুতনী, হাকিম, বায়হাক্বী ইত্যাদিতে কয়েকটি বর্ণনা পাওয়া গেলেও অধিকাংশ হাদীস বিশারদগণের মতে উক্ত বর্ণনাগুলির প্রত্যেকটি দুর্বল।
(২) যে মাটিতে সালাত আদায় জায়েয তা থেকেই রাসূল (সা.) তায়াম্মুম করতেন, হোক তা মাটি, বালু বা লবনের ঢিবি। রাসূল (সা.) বলেছেন, “আমার উম্মত যেখানেই সালাত পড়বে, সেখানেই সালাতের ও পবিত্রতা অর্জনের ব্যবস্থা দেখতে পাবে।”
(৩) রাসূল (সা.) যখন সাহাবাদের নিয়ে তাবুকের যুদ্ধে গেলেন, পানি খুব কম থাকায় বালুই তায়াম্মুমের জন্য ব্যবহার করেছিলেন।
(৪) রাসূল (সা.) প্রত্যেক সালাতের জন্য ভিন্ন ভিন্ন তায়াম্মুম করেছেন বলে জানা যায় না। তিনি সেরূপ আদেশও করেননি। পরন্তু তিনি তায়াম্মুমকে ঠিক ওযুর মর্যাদাই দিয়েছেন।
(৫) আদম (র.) … সা’ঈদ ইবনে আবদুর রহমান ইবনে আবযা তাঁর পিতা [আবদুর রহমান (রা.)] থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.)-এর নিকট এসে জানতে চাইল, একবার আমার গোসলের প্রয়োজন হল, অথচ আমি পানি পেলাম না। তখন আম্মার ইবন ইয়াসির (রা.) উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.)-কে বললেন, আপনার কি সেই ঘটনা স্মরণ আছে যে, এক সময় আমরা দুজন সফরে ছিলাম এবং দুজনেরই গোসলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। আপনি তো সালাত আদায় করলেন না। আর আমি মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে সালাত আদায় করলাম। তারপর আমি ঘটনাটি নবী (সা.) এর কাছে বর্ণনা করলাম। তখন নবী (সা.) বললেন, “তোমার জন্য তো এটুকুই যথেষ্ট ছিল।” এই বলে নবী (সা.) দু’হাত মাটিতে মারলেন এবং দু’হাতে ফুঁ দিয়ে তাঁর চেহারা ও উভয় হাত মাসেহ করলেন। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/৩৩১}
(৬) আবদুর রহমান ইবনে আবযা (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আম্মার (রা.)-ও এই কথা [যা (৫) নং হাদীসে বর্ণিত হয়েছে] বর্ণনা করেছেন। শু’বা (র.) নিজের হস্তদ্বয় মাটিতে মেরে মুখের কাছে মাসেহ করলেন। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/৩৩২}
(৭) মুকীম (নিজ স্থানে বা বাড়ীতে অবস্থানকারী) অবস্থায় পানি না পেলে এবং সালাত ছুটে যাওয়ার ভয় থাকলে তায়াম্মুম করার ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে আতা (র.)-এর অভিমতও এরূপ। হাসান বসরী (র.) বলেন, “যে রোগীর কাছে পানি আছে কিন্তু তার কাছে পৌঁছানোর কোন লোক না থাকে, তবে সে তায়াম্মুম করবে। ইবনে উমর (রা.) তাঁর জুরুফ নামক স্থানের জমি থেকে ফেরার সময় মারবাদুন্না’আম-এ পৌঁছালে আসরের সময় হয়ে যায়। তখন তিনি (তায়াম্মুম করে) সালাত আদায় করলেন। পরে তিনি মদীনা পৌঁছালেন। তখনো সূর্য উপরে ছিল। কিন্তু তিনি সালাত পুনরায় আদায় করলেন না।” {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, ২৩৫ পরিচ্ছেদ}
(৮) জুনুবী (যৌনকর্ম বা বীর্যপাতের কারণে অপবিত্র ব্যক্তি) ব্যক্তির রোগ বৃদ্ধি, মৃত্যুর বা তৃষ্ণার্ত থেকে যাওয়ার আশংকা বোধ হলে তায়াম্মুম করা সম্বন্ধে বর্ণিত আছে যে, এক শীতের রাতে আমর ইবনুল আস্ (রা.) জুনুবী হয়ে পড়লে তায়াম্মুম করলেন। আর (এ প্রসঙ্গে) তিনি এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন, “কখনো নিজেদের হত্যা করো না, অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রতি মেহেরবান।” {সূরা আন্ নিসা, আয়াত ২৯} এরপর রাসূল (সা.)-এর কাছে বিষয়টির উল্লেখ করা হলে তিনি তাকে দোষারোপ করেননি। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, ২৩৯ পরিচ্ছেদ}।
 
তায়াম্মুম (শেষ ভাগ)
তায়াম্মুমের নিয়মঃ
বিসমিল্লাহ বলে পাক-পবিত্র ধুলা মাটিতে উভয় হাত একবার মেরে তাতে ফুঁ দিয়ে দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত একবার মাসেহ করতে হবে। হাতের ভিতর দিক পাক মাটির উপর মারতে হবে, পিঠের দিকে নয়। তারপর উভয় হাতে মুখমন্ডল একবার মাসেহ করতে হবে। কিন্তু কনুই পর্যন্ত মাসেহ করতে হবে না।
তায়াম্মুম শেষে পড়ার দু’আ
ওযুর শেষে পড়ার যে দুইটি দু’আ উল্লেখ করা হয়েছে তায়াম্মুম শেষে ঐ দুটি দু’আর যে কোন একটি পড়া যেতে পারে।
 
তায়াম্মুম ভঙ্গের কারণসমূহঃ
(১) যে সব কারণে ওযু নষ্ট হয়ে যায় সে সব কারণ ঘটলে তায়াম্মুমও নষ্ট হয়ে যায়।
(২) যদি কোন ওজরের (অসুবিধার) কারণে তায়াম্মুম করা হয়ে থাকে তা হলে সেই ওজর না থাকলে সেই তায়াম্মুম নষ্ট হয়ে যায়।
 
তায়াম্মুম সম্বন্ধে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাসাইল (নিয়মকানুন)
(১) পানির দ্বারা পবিত্রতা অর্জনের মাধ্যমে যে সব কাজ করা যায় তায়াম্মুম দ্বারাও সে সব কাজ করা যাবে যেমন, সালাত আদায়, কোরআন স্পর্শ করা ও পড়া, মসজিদে প্রবেশ করা ইত্যাদি। {নায়লুল আওত্বার, ১/৩১১}
(২) যে সব জিনিস দিয়ে তায়াম্মুম করা জায়েয যেমন ইট, পাথর, মাটির পাত্র ইত্যাদি যদি একবার ধোয়া হয় এবং যদি তার উপর কোনরূপ ধূলাবালি নাও থাকে, তথাপি তা দিয়ে তায়াম্মুম করা জায়েয হবে। দেয়াল বা অন্য পাক স্থানে যেখানে ধূলাবালি লেগে থাকে, সেখানে হাত মেরে তায়াম্মুম করা যায়। কিন্তু দেয়ালে যদি তৈলাক্ত পদার্থ থাকে তবে তাতে তায়াম্মুম করা যাবে না। আর যদি মাটিতে, দেয়ালে বা অন্যত্র ধূলা না পাওয়া যায়, তাহলে কোন পাত্রে বা রুমালে ধূলা নিয়ে তাতে হাত মেরে তায়াম্মুম করা যাবে।
(৩) যে সব বস্তু আগুনে জ্বালালে ছাই হয়ে যায় না বা নরম হয়ে যায় না, সেগুলি দিয়ে তায়াম্মুম করা জায়েজ, যেমন, মাটি, সুরমা, চুন, ইট, পাথর, বালু, কংকর ইত্যাদি। কিন্তু ঐ সব জিনিস যা মাটির মত নয় বা আগুনে দিলে জ্বলে ছাই হয়ে যায় অথবা গলে যায়, সেগুলি দিয়ে তায়াম্মুম জায়েয নয়, যেমন কাঠ, লোহা, সোনা, তামা, পিতল, কয়লা, কাপড়, কাগজ ইত্যাদি।
(৪) তায়াম্মুম করে ইমামতি করা যাবে যেমন ইবনে আব্বাস (রা.) করেছেন। {সহীহুল বুখারী} অধিকাংশ জমহুর ওলামাদের মতেও তায়াম্মুম করে ওযুকারীদের সালাতে ইমামতি করা জায়েয। {উমদাতুল ক্বারী}।
(৫) তায়াম্মুম নষ্ট না হলেও প্রতি ওয়াক্ত সালাতের জন্য তায়াম্মুম করা জায়েয। এরূপ করাকে কেউ কেউ ওয়াজিব এবং কেউ কেউ মুস্তাহাব বলেছেন।
(৬) পাক মাটি বা পানি কিছুই না পাওয়া গেলে বিনা ওযুতেই সালাত আদায় করা যাবে। {সহীহুল বুখারী} তবে এই সালাতের ক্বাযা করতে হবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে।
(৭) যে ব্যক্তি আখেরী ওয়াক্তে পানি পাওয়ার আশাবাদী, তার জন্য আওয়াল ওয়াক্তে তায়াম্মুম করা জায়েয। {মালিক} যে ব্যক্তি ওয়াক্তের মধ্যেই পানি পাওয়ার আশাবাদী, তার জন্য বিলম্বে তায়াম্মুম করা উত্তম। {দারাকুতনী}
(৮) কেউ অসুস্থতার কারণে নিজে নিজে ওযু বা তায়াম্মুম করতে অসমর্থ হলে অন্য কেউ তাকে ওযু বা তায়াম্মুম করিয়ে দিতে পারবে।
(৯) পানির অভাবে তায়াম্মুম করে সালাত আদায়ের পর পানি পাওয়া গেলে এবং ওয়াক্ত থাকলেও পুনরায় সালাত আদায় করতে হবে না।
 
~~~সমাপ্ত~~~
 
“আমার নামায কি শুদ্ধ হচ্ছে!”
গ্রন্থ থেকে মুমিন ভাই-বোনদের উপকারার্থে এখানে প্রকাশিত হলো। 

 

মন্তব্য করুন

No comments found.

New comment