ওয়াসওয়াসা তথা শয়তানের কুমন্ত্রনার কবলে পতিত ব্যক্তি কিভাবে তা থেকে রেহাই পাবে?

লিখেছেনঃ আব্দুল্লাহ শাহেদ মাদানী //
আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ বনী আদমের অন্তরে ফেরেশতার পক্ষ হতে ইলহাম হয়। শয়তানও বনী আদমের অন্তরে কুমন্ত্রনা ঢেলে দেয়। ফেরেশতা তার সাথে কল্যাণের ওয়াদা করে, সত্যের সত্যায়ন করে এবং অন্তরে ভাল কাজের বিনিময়ে ছাওয়াবের আশা-আকাঙ্খা জাগ্রত করে। শয়তানের কুমন্ত্রনা হচ্ছে অন্যায় কাজের ওয়াদা করা, সত্যকে অস্বীকার করা এবং কল্যাণ অর্জন তেকে নিরাশ করা। সুতরাং তোমরা যখন অন্তরে ফেরেশতার ইলহাম অনুভব কর তখন আল্লাহর প্রশংসা কর এবং আল্লাহর কাছে কল্যাণ কামনা কর। আর যখন শয়তানের ওয়াসওয়াসা অনুভব কর তখন আল্লাহর কাছে শয়তানের কুমন্ত্রনা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা কর এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর।
উছমান বিন আবুল আস নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললঃ আমার মাঝে এবং আমার নামায ও কিরাআতের মাঝে শয়তান প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ এই শয়তানের নাম হচ্ছে খিনযাব। যখন তুমি তার উপস্থিতি অনুভব করবে তখন আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা কর এবং তোমার বাম দিকে তিনবার থুথু নিক্ষেপ কর।
সাহাবীগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে অভিযোগ করল যে, তাদের অন্তরে এমন জিনিসের উদয় হয়, যা মুখে উচ্চারণ করার চেয়ে তার কাছে আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া অধিক প্রিয় বলে মনে হয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ আল্লাহু আকবার। ঐ আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা, যিনি শয়তানের চক্রান্তকে ওয়াসওয়াসার দিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। যার কাছে সৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তার ব্যাপারে ওয়াস্ওয়াসা এবং একের পর এক যদি এভাবে প্রশ্নের উদয় হয় যে, এই তো আল্লাহ্ সকল মাখলুক সৃষ্টি করেছেন, তাহলে কে আল্লাহকে সৃষ্টি করেছে? এমন পরিস্থিতিতে তিনি কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করারআদেশ দিয়েছেনঃ
الأوَّلُ وَالآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
“তনিই প্রথম, তিনিই সর্বশেষ, তিনিই প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান এবং তিনি সর্ববিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত”। (সূরা হাদীদঃ ৩) এমনিভাবে আবু যামীল ইবনে আব্বাস (রাঃ)কে প্রশ্ন করেছিল, এ কি জিনিস যা আমার বক্ষদেশে কিছু অনুভব (ওয়াসওয়াসা বা কুমন্ত্রনা) করছি। আব্দুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বললেনঃ সেটি কি? তিনি বলেনঃ আমি বললামঃ আল্লাহর কসম! আমি এ ব্যাপারে কথা বলব না। ইবনে আব্বাস তখন বললেনঃ সেটি কি কোন সন্দেহ? আমি বললামঃ হ্যাঁ। আল্লাহ্ তাআলা এ ব্যাপারে কুরআনের আয়াত নাযিল না করা পর্যন্ত কেউ এ থেকে রেহাই পায়নি। সুতরাং তুমি যখন তোমার অন্তরে এমন কিছু অনুভব কর তখন এই আয়াতটি পাঠ করবেঃ
الأوَّلُ وَالآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ
“তনিই প্রথম, তিনিই সর্বশেষ, তিনিই প্রকাশমান ও অপ্রকাশমান এবং তিনি সর্ববিষয়ে সম্যক পরিজ্ঞাত”। (সূরা হাদীদঃ ৩) এই আয়াতের মাধ্যমে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিমদেরকে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন যে, স্বচ্ছ বিবেক তাসালসুল তথা আদি-অন্তহীন সৃষ্টির অস্তিত্বতে বাতিল সাব্যস্ত করে। সৃষ্টির প্রারম্ভ এমন এক প্রথম সত্ত্বার পর্যন্ত গিয়ে শেস হয়, যার পূর্বে আর কোন সৃষ্টি নেই। এমনভিাবে এমন এক শেষ সত্ত্বা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়, যার পরে আর কোন সৃষ্টি নেই। অর্থাৎ যখন কোন মাখলুকের (সৃষ্টির) অস্তিত্ব ছিল না তখন আল্লাহ্ ছিলেন আবার যখন কোন কিছুই থাকবে না, সব কিছুই ধ্বংস হবে তখনও একমাত্র আল্লাহই অবশিষ্ট থাকবেন। তিনিই ‘যাহের’ এ কথার তাৎপর্য হচ্ছে, আল্লাহর উপরে অন্য কোন বস্তু বা সৃষ্টি নেই। তিনি জ্ঞান ও শক্তির মাধ্যমে উর্ধ জগতের সবকিছু বেষ্টন করে আছেন। আর তিনিই বাতেন, এ কথার তাৎপর্য হচ্ছে তিনি সকল মাখলুককে (সৃষ্টিকে) এমনভাবে বেষ্টন করে আছেন, যার বাইরে অন্য কিছু নেই। এক কথায় ظاهر বলতে উর্ধজগতের (আসমান ও তার মধ্যকার) সকল সৃষ্টির উপর আল্লাহর কর্তৃত্বকে বুঝানো হয়েছে আর باطن বলতে নিম্নজগতের (যমীন ও তার মধ্যকার) সকল বস্তুর উপর তাঁর কর্তৃত্বকে বুঝানো হয়েছে।
অনুবাদকের সংযুক্তিঃ
আল্লাহর অন্যতম গুনবাচক নাম الظاهر والباطن এর বাংলা অনুবাদ করা হয় প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য শব্দ দিয়ে। এভাবে অনুবাদের মাধ্যমে এই নাম দু’টির যথাযথ অর্থ প্রকাশিত হয় না। আলেমগণ এই নাম দু’টির যে ব্যাখ্যা করেছেন, তা বাংলা ভাষায় ইতপিূর্বে কোন বই-পুস্তকে খেলাসা করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। তাই বাংলাভাষী মুসলিম ভাইদের জন্য এখানে এই গুরুত্বপূর্ণ নাম দু’টির অর্থ বর্ণনায় আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের আলেমদের মতামত তুলে ধরছি।
১) কেউ কেউ বলেনঃ الظاهر অর্থ হাদীছে বর্ণিত হয়েছেঃ وأنت الظاهر فليس فوقك شيء হে আল্লাহ্! আপনি সবার উপরে আপনার উপরে আর কিছু নেই। সুতরাং যাহের নামের মাধ্যমে বুঝানো হচ্ছে যে, আল্লাহ্ তাআলার অবস্থান সকল মাখলুকের উপর। সাত আসমানের উপরে আরশে আযীমে তিনি সমুন্নত। ক্ষমতা ও প্রতিপত্তিতেও তিনি সকল সৃষ্টির উপরে।
২) কেউ কেউ বলেনঃ যাহের অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্ উর্ধজগতের সকল বিষয়কে বেষ্টন করে আছেন। সুতরাং সাত আসমান ও তাতে যা আছে তার সবকিছুই আল্লাহ্ তআলা স্বীয় জ্ঞান ও ক্ষমতার মাধ্যমে পরিবেষ্টন করে আছেন। উর্ধ জগতের কোন কিছুই তার জ্ঞান ও ক্ষমতার বাইরে নয়।
আর الباطن বাতেন অর্থ হচ্ছে, যা সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, وأنت الباطن فليس دونك شيء হে আল্লাহ্! আপনিই বাতেন তথা সকল গোপন বিষয়কে পরিবেষ্টনকারী। আপনার বেষ্টনীর বাইরে কেউ নেই। সুতরাং অধঃস্তন ও নিম্ন জগতের সকল বিষয়কে তিনি জ্ঞান ও ক্ষমতার মাধ্যমে বেষ্টন করে আছেন। সাত যমীন ও তার মধ্যে অবস্থানকারী কোন বস্তুই তাঁর জ্ঞান ও ক্ষমতার বাইরে নয়। তিনি যমীনের সকল মাখলুকের গোপন রহস্যও সুক্ষèাতিসুক্ষè সম্পর্কে অবগত আছেন।
২) কোন কোন আলেম বলেনঃ الباطن অর্থ হচ্ছে নিকটে। এই অর্থে আল্লাহ্ তাআলা সকল মাখলুকের নিকটে। তিনি জ্ঞানের মাধ্যমে সৃষ্টির অতি নিকট থেকে তাদেরকে বেষ্টন করে আছেন। তাদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব কিছুই জানেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ وَلَكِنْ لا تُبْصِرُونَ
তখন আমি তোমাদের অপেক্ষা তার অধিক নিকটে থাকি; কিন্তু তোমরা দেখ না। (সূরা ওয়াকিআঃ ৮৫) আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ
আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি এবং তার মন নিভৃতে যে কুচিন্তা করে, সে সম্বন্ধেও আমি অবগত আছি। আমি তার গ্রীবাস্থিত ধমনী থেকেও অধিক নিকটবর্তী। (সূরা কাফঃ ১৬) এমনি আরও যে সমস্ত আয়াতে দয়াময় আল্লাহ্ তাআলা বান্দার নিকটে থাকার কথা বলা হয়েছে, তার মর্ম হচ্ছে তিনি জ্ঞান ও ক্ষমতার মাধ্যমে সকলের অতি নিকটে। অথচ তিনি স্বীয় সত্তায় সকল মাখলুকের উপরে আরশে আযীমে সমুন্নত। উভয় প্রকার আয়াতের মধ্যে আলেমগণ এভাবেই সমন্বয় করেছেন। তিনি মাখলুকের সাথে মিশে একাকার হয়ে থাকা হতে পবিত্র। আল্লাহই ভাল জানেন। সংযুক্তি এখানেই শেষ।
তাঁর পূর্বে যদি কোন বস্তু থাকত, তাহলে তা স্রষ্টার উপর প্রভাব বিস্তারকারী হয়ে যেত এবং সেই বস্তুই হত মহান সৃষ্টিকর্তা ও পরিচালক। সুতরাং তিনিই প্রথম, যার পূর্বে আর কেউ নেই, তিনিই শেষ, যার পরে আর কেউ নেই। সৃষ্টির ধারাবাহিকতা ও ক্রমবিকাশ এমন এক সৃষ্টি কর্তা পর্যন্ত গিয়ে অবশ্যই শেষ হবে, যিনি অন্যের প্রতি মুখাপেক্ষী নন, কিন্তু সবকিছুই তাঁর দিকে মুখাপেক্ষী, যিনি স্বনির্ভর, সকল বস্তু তাঁর উপর নির্ভরকারী, তিনি নিজেই অস্তীত্বশীল, কিন্তু অন্যসব বস্তু তাঁর কারণেই অস্তীত্বশীল। তিনি আদি থেকেই আছেন এবং তাঁর কোন শুরু নেই। তিনি ব্যতীত বাকী সবই অস্তীত্বহীন থেকে অস্তীত্বে এসেছে। তাঁর সত্ত্বা স্থায়ী থাকবে এবং প্রত্যেক বস্তুর স্থায়িত্ব তাঁর কারণেই। সুতরাং তিনিই প্রথম, তাঁর পূর্বে আর কেই নেই। তিনিই শেষ, তাঁর পরে আর কেউ নেই। তিনিই সবার উপরে, তাঁর উপরে আর কেউ নেই। তিনি আকাশের উপর আরশে সমুন্নত। তিনিই সকলের নিকটে, তার চেয়ে অধিক নিকটে আর কেউ নেই।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ লোকেরা পরস্পর জিজ্ঞেস করতে থাকবে। এক পর্যায়ে তাদের কেউ বলবে, এই তো আল্লাহ্ তাআলা সব কিছু সৃষ্টি করেছেন। তাহলে আল্লাহ্কে সৃষ্টি করেছে কে? যে ব্যক্তির হৃদয়ে এ ধরণের প্রশ্নের উদয় হবে, সে যেন আল্লাহর কাছে শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করে এবং এ ধরণের কিছু চিন্তা করা হতে থেমে যায়। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَإِمَّا يَنزغَنَّكَ مِنَ الشَّيْطَانِ نزغٌ فَاسْتَعِذْ بِاللَّهِ إِنَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
যদি শয়তানের পক্ষ থেকে আপনি কিছু কুমন্ত্রণা অনুভব করেন, তবে আল্লাহ্র শরণাপন্ন হোন। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ। (সূরা হা-মীম সাজদাহঃ ৩৬)

মন্তব্য করুন।

No comments found.

New comment