কথা-বার্তায় সংযত হওয়া এবং শব্দ নির্বাচন ও তা প্রয়োগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সতর্কতা

লিখেছেনঃ আব্দুল্লাহ শাহেদ ///

তিনি তাঁর ভাষণে সুন্দরতম শব্দ নির্বাচন করতেন এবং তাঁর উম্মাতের জন্যও তাই নির্বাচন করেছেন। অশ্লীল ও কঠোর শব্দ ব্যবহার করতে নিষেধ করেছেন। তিনি কর্কশভাষী ছিলেন না, তিনি তা পছন্দও করতেন না, তিনি উঁচু আওয়াজে তথা চিল্লিয়ে ও কঠোর ভাষায় কথা বলতেন না। সম্মানী ব্যক্তি নয়- এমন ব্যক্তির জন্য তিনি উত্তম শব্দ ব্যবহার কারা অপছন্দ করতেন। আর সম্মানী ব্যক্তির ক্ষেত্রে অপছন্দনীয় শব্দ ব্যবহার করাও তিনি সমর্থন করতেন না।

 প্রথম প্রকারের উদাহরণ হলে মুনাফিক লোককে কখনই সায়্যেদ (নেতা) বলা যাবে না এবং আঙ্গুরকে কারাম বলা যাবে না। এর উপর ভিত্তি করেই আবু জাহেলকে আবুল হাকাম বলা যাবে না। তিনি সাহাবীদের মধ্যে আবুল হাকামের (বিচারকদের বিচারক) নাম পরিবর্তন করে আবু শুরাইহ রেখেছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেনঃ প্রকৃত বিচারক তো একমাত্র আল্লাহ্। তাঁর পক্ষ থেকেই ফয়সালা আসে। তিনি চাকরকে আদেশ দিয়েছেন, সে যেন তার মনিবকে রাব্বী তথা আমার প্রভু না বলে। এমনিভাবে মনিবকে বলেছেন সে যেন স্বীয় চাকরকে আবদী তথা আমার বান্দা এবং আমার বান্দী না বলে।

 এক ব্যক্তি নিজেকে ডাক্তার (চিকিৎসক) হিসাবে দাবী করলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ তুমি হলে রফীক (রোগীর প্রতি দয়াকারী)। যিনি তাকে সৃষ্টি করেছেন তিনিই তার প্রকৃত চিকিৎসক। চিকিৎসা শাস্ত্রে সামান্য জ্ঞানের অধিকারী কাফেরদেও জাহেলরা হাকীম (মহা চিকিৎসক, মহা জ্ঞানী) বলে থাকে। অথচ প্রকৃত হাকীম হচ্ছেন একমাত্র আল্লাহ্ তাআলা। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সর্বাধিক মূর্খ হচ্ছে কাফেরের দল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন এক বক্তাকে বলতে শুনলেনঃ

 وَمَنْ يَعْصِهِمَا فَقَدْ غَوَى

 যে ব্যক্তি তাদের উভয়ের (আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের) নাফরমানী করল সে ব্যক্তি গোমরাহ হল। এ কথা শুনে তিনি বললেনঃ তুমি খুব নিকৃষ্ট বক্তা। আসলে তার বলা উচিত ছিল এভাবেঃ

 مَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ رَشَدَ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ غَوَى

 যে ব্যক্তি আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে সে সুপথ প্রাপ্ত হবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের নাফরমানী করবে, সে গোমরাহ হবে। ঐ লোকটি প্রথমে আল্লাহর নাম উল্লেখ করে এবং রাসূল কথাটি পরে উল্লেখ না করে সর্বনামের মাধ্যমে সরাসরি অর্থাৎ ‘তাদের উভয়ের’ কথাটির মাধ্যমে আল্লাহ্ এবং রাসূলকে সমান করে দেয়ায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে নিকৃষ্ট বক্তা বলেছেন। এরই অন্তর্ভূক্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণীঃ তোমরা এ কথা বলো না যে, ما شاء الله وشاء فلان অর্থাৎ আল্লাহ্ যা চান এবং অমুক, আপনি বা সে যা চায়। বরং বলতে হবে যদি আল্লাহ চান কিংবা যদি আল্লাহ্ চান অতঃপর আপনি যদি চান। এবং-এর মাধ্যমে উভয়কে একই বিষয়ে একত্রিত করা হলে উভয়েই সমান ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার সন্দেহ সৃষ্টি হতে পারে। অতঃপর-এর মাধ্যমে সেটি করা হলে তেমন কোন সন্দেহ হবেনা। যে ব্যক্তি শির্ক থেকে বাঁচার জন্য সতর্কতা অবলম্বন করেনা তার কথাও অনুরূপ। তার কথাঃ আমি আল্লাহর সাথে এবং তোমার সাথে আছি, আমি আল্লাহ্ এবং তোমার হেফাজতে আছি, আমার জন্য আল্লাহ্ এবং তুমি ছাড়া আর কেউ নেই, আমি আল্লাহর উপর এবং তোমার উপর ভরসা করছি, এটি আল্লাহ্ এবং তোমার পক্ষ হতে, আল্লাহর শপথ এবং তোমার হায়াতের শপথ ইত্যাদি। এ ধরণের অসংখ্য কথার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সাথে সৃষ্টিকে (মানুষকে) শরীক করে থাকে। এই কথাগুলো ‘আল্লাহ্ যা চান এবং সে যা চায়’ বলা থেকেও অধিক নিকৃষ্ট।

 তবে যখন বলবে যে, আমি আল্লাহর সাথে অতঃপর তোমার সাথে আছি, আল্লাহ্ যা চান অতঃপর আপনি যা চান তাহলে কোন সমস্যা নেই। যেমন তিন ব্যক্তির হাদীছে এসেছে, এখন আমি আল্লাহর অনুগ্রহ অতঃপর আপনার সাহায্য ব্যতীত ঘরে ফিরতে পারব না।

 আর দ্বিতীয় প্রকারের উদাহরণ অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিন্দার হকদার নয় তার ক্ষেত্রে নিন্দাসূচক শব্দ ব্যবহার করার উদাহরণ হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যুগকে গালি দিতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেছেনঃ আল্লাহই হচ্ছেন যুগ তথা যুগের ও তার ভাল-মন্দের সৃষ্টিকারী এবং যুগের উলট-পালটকারী। যুগকে গালি দেয়াতে তিনটি সমস্যা রয়েছে।

 (১) যে গালির হকদার নয়, তাকে গালি দেয়া। (২) যুগকে গালি দেয়া শির্কের অন্তর্ভূক্ত। কেননা যুগকে গালি দাতা এই মনে করেই গালি দেয় যে, উহা লাভ ও ক্ষতির মালিক এবং যুগ বা যামানা হচ্ছে জালেম। অনেক কবিই তাদের কবিতার মাধ্যমে যামানাকে গালি দেয় এবং বহু সংখ্যক অজ্ঞ লোকও যামানাকে লানত ও দোষারূপ করে থাকে। (৩) যারা যামানাকে গালি দেয়, দোষারূপ করে মূলতঃ গালি তাদের উপরই পতিত হয়। প্রকৃত কথা হচ্ছে আল্লাহ্ তাআলা যদি মানুষের মনের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করেন, তাহলে আসমান-যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। কারণ তাদের অবস্থা যখন তাদের চাহিদা অনুযায়ী হয় তখন তারা যুগের প্রশংসা করে এবং তার গুণকীর্তন করে। আর যখন তাদের অবস্থা এর বিপরীত হয় তখন তারা যুগকে গালি দেয়।

 নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ তোমাদের কেউ যেন (হোঁচট খেলে বা পা পিছলে পড়ে গিয়ে কিংবা কারও হাত থেকে কিছু পড়ে গেলে) এ কথা না বলে যে, শয়তান ধ্বংস হোক! কেননা এ কথা বললে তা শুনে শয়তান মোটা হতে থাকে। এমনকি ঘরের মত বড় হয়ে যায় এবং বলতে থাকে আমি স্বীয় শক্তিতে তাকে পরাজিত করেছি। বরং সে যেন বলেঃ বিসমিল্লাহ। কেননা এ কথা বললে শয়তান ছোট হতে হতে মাছির ন্যায় হয়ে যায়।

 অন্য হাদীছে আছে, বান্দা যখন শয়তানকে লানত করে তখন সে বলে তুমি তো একজন অভিশপ্তকেই অভিশাপ করছ। উপরের কথাটির মতই এ কথাটি বলা যে, আল্লাহ্ শয়তানকে লাঞ্জিত করুক, শয়তানের মুখকে কালো করুক এ জাতিয় সকল কথাতেই শয়তান খুশী হয়। সে বলেঃ বনী আদম জানে যে, আমার শক্তির মাধ্যমে আমি তাদের ক্ষতি করি। এ রকম বললে কোন উপকার তো হয়না; বরং শয়তানকে গোমরাহ করার কাজে সহায়তা করা হয়। যার উপর শয়তানের প্রভাব পড়ে তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর নাম, আল্লাহর যিকির, আল্লাহর নাম উচ্চারণ এবং শয়তান থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে বলেছেন। এটিই তার জন্য অধিক উপকারী এবং শয়তানের ক্রোধ বৃদ্ধিকারী।

 নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে এও বলতে নিষেধ করেছেন যে, خبثت نفسي খাবুছাত নাফসী অর্থাৎ আমার চরিত্র দুষ্ট হয়ে গেছে। বরং সে যেন বলেঃ لقست نفسي লাকিসাত নাফসী। উভয় কাক্যের অর্থ একটিই। তা হচ্ছে অভ্যাস ও চরিত্র নষ্ট হয়ে গেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম خبث শব্দটি প্রয়োগ করা অপছন্দ করেছেন। কারণ তা কদর্যতা ও নোংরামীর মাত্রাতিরিক্ত অর্থ প্রকাশ করে।

 কোন কিছু অর্জন করতে ব্যর্থ হলে তিনি এ কথা বলতে নিষেধ করেছেন যে, যদি এমন করতাম তাহলে এমন হত। কেননা এরূপ ক্ষেত্রে ‘যদি’ কথাটি শয়তানের কাজকে সহজ করে দেয়। তিনি এর চেয়ে উত্তম কথা শিক্ষা দিয়েছেন এবং এ কথা বলার আদেশ দিয়েছেন যে, قدر الله وماشاء فعل এটি ছিল আল্লাহর ফয়সালা, তিনি যা চান তাই করেন। কেননা মানুষের কথা, আমি যদি এ রকম করতাম, তাহলে এ বস্তুটি আমার হাত ছাড়া হত না, এমনটি না করলে আমি এই বিপদে পড়তাম না। এ জাতিয় কথায় কোন উপকার নেই। কেননা যা চলে গেছে তা পুনরায় ফেরত আসবে না এবং ‘যদি’ কথাটি ব্যবহার করেও ভবিষ্যতে কোন উপকার পাওয়া যাবে না।

 মানুষ নিজের মনে মধ্যে যে সমস্ত বিষয় স্থির ও নির্ধারণ করে, তা যদি সেভাবেই সংঘটিত হয় তাহলে এমন জিনিষ সংঘটিত হওয়াকে আবশ্যক করবে যা আল্লাহর নির্ধারণের (তাকদীরের) বাইরে। অথচ আল্লাহ্ তাআলা কর্তৃক নির্ধারিত বিষয়ের বিপরীত হওয়া অসম্ভব। সুতরাং মিথ্যা, মূর্খতা এবং অসম্ভব বিষয়ের উপর ভিত্তি করেই এ রকম চিন্তার উদ্ভব হয়। এরূপ ক্ষেত্রে তাকদীরকে অস্বীকার করার দোষ থেকে মুক্ত হলেও ‘যদি’ বলার অপরাধ থেকে মুক্তি পাবে না।

 যদি বলা হয় ‘যদি’ কথাটি বলার মাধ্যমে যে সমস্ত বিষয় কামনা করছে, তাও তো তাকদীরেই নির্ধারিত? উত্তরে বলা হবে যে, এ কথা সঠিক। কিন্তু নির্ধারণকৃত অপছন্দনীয় বিষয়টি সংঘটিত হওয়ার পূর্বে বললে লাভ হত। সংঘটিত হয়ে যাওয়ার পর তা বললে অপছন্দনীয় বিষয়টি দূর হবে না বা তার প্রভাব কমানোও সম্ভব নয়। বরং এ অবস্থায় বান্দা ভবিষ্যতে এমন কাজ করবে, যার মাধ্যমে সে অপছন্দনীয় বিষয়টি দূর করতে পারবে এবং তার ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো কমানো সম্ভব হবে। যা সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয়, তা সংঘটিত হওয়ার আশা করাতে কোন লাভ নেই। কেননা এটি শুধু অপারগতার দিকেই নিয়ে যাবে। আল্লাহ্ তাআলা অপারগতা-অক্ষমতা প্রকাশ করাকে অপছন্দ করেন এবং সতর্কতা অবলম্বন ও কর্মঠ হওয়াকে ভালবাসেন। যা করলে কল্যাণের পথ খুলবে তিনি তা করার আদেশ দিয়েছেন। আর لو (যদি) বলা অপারগতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করা শয়তানের কাজকেই সহজ করে দেয়। কেননা উপকারী কাজ করা থেকে বিরত থাকলে বান্দা বাতিল ও অষ্পষ্ট আশা-আকাঙ্খার দিকে ধাবিত হয়। এই জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অপারগতা-অক্ষমতা ও অলসতা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছেন। এ দু’টিই সকল অকল্যাণের দ্বারকে উন্মুক্ত করে। এ থেকেই দুশ্চিন্তা, হাতাশা, পেরেশানী, কাপুরুষতা, কৃপণতা, ঋণগ্রস্ত হওয়া, পুরুষদের পরাজয় ইত্যাদি দোষণীয় বিষয়ের সূচনা হয়। এ সবের উৎস হচ্ছে অপরাগতা-অক্ষমতা ও অলসতা। আর لو (যদি) কথাই এর শিরোনাম।

 যে ব্যক্তি কাজ করে না এবং শুধু আশা-ভরসা করে বসে থাকে, সেই সবেচেয়ে বেশী দরিদ্র ও অক্ষমে পরিণত হয়। অক্ষমতা-অপারগতা থেকেই সকল পাপ কাজের সূচনা। কেননা অক্ষমতা প্রকাশ করেই বান্দা সৎকাজ করার রাস্তা থেকে দূরে থাকে এবং যে সমস্ত পন্থা তার মাঝে এবং অন্যায় কাজে লিপ্ত হওয়ার মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায় তা এবং পাপ কাজে থেকে দূরে থাকার উপায়-উপকরণ অবলম্বন করাও বর্জন করে। পরিণামে সে অপরাধের সাগরে প্লাবিত হয়। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উপরোক্ত হাদীছ শরীফে (‘যদি’ কথাটি বলা নিষিদ্ধ করার হাদীছে) অন্যায়ের সকল শেকড়, শাখা, সূচনা, প্রবেশ পথ এবং সকল উৎস একত্রিত করেছেন। এই হাদীছ আটটি খারাপ অভ্যাসকে অন্তর্ভূক করেছে। প্রত্যেক দু’টি অভ্যাস পরস্পর সম্পৃক্ত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুআয় বলতেনঃ

 اللَّهُمَّ إِنِّى أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ وَالْبُخْلِ وَالْجُبْنِ وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ

 হে আল্লাহ, আমি উদ্বিগ্ন হওয়া, বিষণ্ণ হওয়া, অক্ষম হওয়া, আলসতা করা, কৃপণতা করা, ভীরু হওয়া, এবং ঋণের আধিক্য, এবং পুরুষদের অন্যায় প্রাধান্য ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়া থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

 হাম্ম ও হুয্ন অর্থাৎ উদ্বিগ্ন হওয়া, বিষণ্ণ হওয়া পরস্পর সম্পৃক্ত এবং এক সাথেই আপতিত হয়। কেননা অন্তরে যে অপছন্দ আপতিত হয় তা হয়ত অতীতে কোন বস্তু হারানোর কারণেই হয়। আর এটিই হুয্ন তথা বিষণ্ণতার সৃষ্টি করে অথবা ভবিষ্যতে সংঘটিতব্য কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে আর এটিই উদ্বিগ্নতার জন্ম দেয়। বিষণ্ণতা ও উদ্বিগ্নতা উভয়টিই আসে অপরাগতা-অক্ষমতা থেকে। যে বস্তু অতীতে হাত ছাড়া হয়েছে হয়ে গেছে বা যে বিপদ হয়েছে তা দুশ্চিন্তার মাধ্যমে ফেরত আসবে না বা এর মাধ্যমে কোন বিপদ দূর হবেনা। বরং তাকদীরের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, আল্লাহর প্রশংসা, ধৈর্যধারণ এবং তাকদীরের প্রতি ঈমান আনয়নের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে মেনে নিতে হবে। এবং এ কথা বলার মাধ্যমে যে, قَدَّرَ اللَّهُ وَمَاشَاءَ فَعَلَ অর্থাৎ এটি ছিল আল্লাহর ফয়সালা, তিনি যা ইচ্ছা করেছেন তাই করেছেন।

 ভবিষ্যতে যে অপছন্দনীয় ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, উদ্বিগ্ন হওয়ার মাধ্যমে তা দমন করা যাবে না। বরং তা দূর ও দমন করার জন্য কৌশল অবলম্বন করতে হবে। তা দূর করার জন্য কৌশল নির্ধারণে কখনই অক্ষমতা ও অপরাগতা প্রকাশ করবে না। আর যদি এমন হয় যে, কৌশল অবলম্বন করেও তা দূর করা সম্ভব নয়, তাহলে হতাশা ও বিরক্তি প্রকাশ করা যাবে না। বরং তাওহীদ, তাওয়াক্কুল এবং সুখে-দুঃখে আল্লাহকে প্রভু হিসাবে মেনে নেওয়ার মাধ্যমে সকল বিপদাপদ বরদাস্ত করতে হবে। দুশ্চিন্তা-বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতা মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে দুর্বল করে ফেলে, অন্তরকে রোগাক্রান্ত করে দেয় এবং বান্দা ও কল্যাণকর কাজের প্রচেষ্টার মধ্যে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এই দৃষ্টিকোন থেকে দুশ্চিন্তা ও উদ্বিগ্নতা কল্যাণের পথে চলতে আগ্রহীর পিঠে বিরাট এক বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

 মহা পরাক্রমশালী আল্লাহ্ তাআলার হিকমতের অন্তর্ভূক্ত হচ্ছে, তিনি এই দুটি শত্রুকে (দুশ্চিন্তা-বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্নতাকে) আল্লাহ্ বিমুখ এবং তাঁর ভালবাসা ও ভয় থেকে শূণ্য অন্তরসমূহের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। যাতে করে তিনি এর মাধ্যমে অন্তরসমূহকে বিপদগ্রস্ত করে তাঁর বান্দাদেরকে অনেক নাফরমানী পাপাচারিতা থেকে বিরত রাখতে পারেন।

 তাওহীদের প্রশস্ত ময়দানে না আসা এবং আল্লাহমুখী না হওয়া পর্যন্ত অন্তরগুলো সর্বদা দুশ্চিন্তা ও উদ্বিগ্নতার কষ্টের বন্ধীখানায় আটকা থাকে। এই বন্ধীশালা ও দুঃখ-ক্লেষ থেকে বের হয়ে আসার জন্য অন্তরের সামনে তাওহীদের পথ ব্যতীত অন্য কোন পথ খোলা নেই এবং এক মাত্র আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছারও কোন সুযোগ নেই। আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছার জন্যে আল্লাহর সাহায্য জরুরী। তা ব্যতীত আল্লাহর নৈকট্য লাভ সম্ভব নয়, আল্লাহ্ ব্যতীত সেই পথ দেখানোর জন্য অন্য কোন পথপ্রদর্শক নেই, তিনি ছাড়া সৎকাজের তাওফীক দাতা ও অন্যায় কাজ থেকে বাধা দানকারী অন্য কেউ নেই।

 আল্লাহ্ যখন তাঁর কোন বান্দাকে কোন স্থানে রাখেন তখন তিনি স্বীয় ইচ্ছা ও বিশেষ হিকমতের কারণেই সেখানে রাখেন। বান্দাকে কোন হক থেকেই আল্লাহ্ বঞ্চিত করেন না। যদি কোন কোন ক্ষেত্রে বঞ্চিত করেনও তাহলে উদ্দেশ্য হচ্ছে বান্দা যাতে আল্লাহর নিকট পছন্দনীয় কাজসমূহ সম্পাদনের মাধ্যমে তা অর্জন করার চেষ্টা করে, তারই এবাদত করে এবং তাঁর সামনেই নত হয়। পরিণামে আল্লাহ্ তাকে উহা দান করেন। আল্লাহ্ কখনও তাঁর বান্দাকে তাঁর দিকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য কোন কিছু দেয়া থেকে বিরত থাকেন, তাকে সম্মানিত করার জন্য অপমানিত করেন, তাকে ধনী করার জন্য তাঁর দিকে মুখাপেক্ষী করেন, তাকে শক্তিশালী করার জন্য তাঁর সামনে তাকে দুর্বল করেন, ভাল ও মূল্যবান পদ থেকে অপসারণের মাধ্যমে তাকে স্বীয় বন্ধুত্বের পদে অধিষ্ঠিত করেন এবং বঞ্চিত করার তিক্ততা আস্বাদন করানোর মাধ্যমে তার দরবারে বিনয়ী হওয়ার স্বাদ উপভোগ করান। সুতরাং আল্লাহ্ কর্তৃক তাঁর বান্দাকে বঞ্চিত করাও দান, তার শাস্তি হচ্ছে শিক্ষা এবং শত্র“কে তার উপর শক্তিশালী করা বান্দাকে তাঁর দিকেই পরিচালনা করার অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ্ স্বীয় দানের পাত্র ও হকদার সম্পর্কে অধিক অবগত আছেন এবং স্বীয় রেসালাত রাখার পাত্র সম্পর্কেও অধিক জানেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

 وَكَذَلِكَ فَتَنَّا بَعْضَهم بِبَعْضٍ لِّيَقُولُوا أَهَؤُلاَءِ مَنَّ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِّن بَيْنِنَا، ألَيْسَ اللَّهُ بأَعْلَمَ بِالشَّاكِربنَ

 “আর এভাবেই আমি কিছু লোককে কিছু লোক দ্বারা পরীক্ষায় ফেলেছি- যাতে তারা বলে যে, এদেরকেই কি আমাদের সবার মধ্য থেকে আল্লাহ্ স্বীয় অনুগ্রহ দান করেছেন? আল্লাহ্ কি কৃতজ্ঞদের সম্পর্কে সুপরিজ্ঞাত নন? (সূরা আনআমঃ ৫৩) আল্লাহ্ তাআলা দান করার জন্য উপযুক্ত কিংবা অনুপযুক্ত স্থান ও ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে অবগত আছেন। আল্লাহ্ কাউকে বঞ্চিত করলে সে যদি আল্লাহর দিকে ফেরত আসে তাহলে এটিই সেই বান্দার জন্য দান হিসাবে পরিগণিত হয়, কাউকে দান করার কারণে যদি সে বিপথগামী হয় তাহলে সে প্রকৃত পক্ষে (আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত থেকে) বঞ্চিত হল।

 সুতরাং যে সব বিষয় ও বস্তু বান্দাকে আল্লাহ থেকে দূরে রাখে তা মূলতঃ তার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে শাস্তি স্বরূপ আর যেসব বিষয় তাকে আল্লাহর দিকে ফিরিয়ে আনে এবং আল্লাহর নিকটবর্তী করে সেগুলো তার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে রহমত স্বরূপ। যদিও তা দুনিয়ার কোন নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে হয়।

 আল্লাহ্ চেয়েছেন যে, বান্দা আমল করবে। আর সে কখনও আল্লাহ্ তাআলার সাহায্য বতীত আমল করতে সক্ষম নয়। সুতরাং তিনি আমাদেরকে সঠিক পথে থাকার আদেশ দিয়েছেন এবং সেই পথে টিকে থাকার মাধ্যম গ্রহণ করারও উপদেশ দিয়েছেন। তিনি সংবাদ দিয়েছেন যে, এই উদ্দেশ্যটি (বান্দার আমল) ততক্ষণ পর্যন্ত সংঘটিত হবে না যতক্ষণ না তিনি আমাদেরকে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ও কার্য সম্পাদনে সহায়তা করবেন এবং আমাদের দ্বারা কাজটি সম্পাদিত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করবেন। সুতরাং দু’টি ইচ্ছা থাকতে হবে। একটি হচ্ছে বান্দার ইচ্ছা। বান্দা কাজ করার ইচ্ছা করবে। অন্যটি হচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহর ইচ্ছা হচ্ছে তিনি তার বান্দাকে কাজ করতে সাহায্য করবেন। আল্লাহর এই ইচ্ছা ব্যতীত বান্দার পক্ষে কোন কাজ করা সম্ভব নয়। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

 وَمَا تَشَاءُونَ إلاَّ أَن يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ

 “তোমরা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের ইচ্ছার বাইরে অন্য কিছুই ইচ্ছা করতে পার না”। (সূরা তাকবীরঃ ২৯)

 সার কথা হচ্ছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুশ্চিন্তা-বিষণ্নতা ও উদ্বিগ্ন হওয়া থেকে আশ্রয় চেয়েছেন। এ দু’টি হচ্ছে পরস্পর বন্ধু। আর তিনি অক্ষম-অপারগতা প্রকাশ করা থেকেই আশ্রয় চেয়েছেন। এরাও পরস্পর সম্পৃক্ত। কেননা বান্দা সংশোধন ও সফলকাম না হতে পারলে তা কখনও তার শক্তি ও ক্ষমতা না থাকার কারণেই হয়ে থাকে। আর এটিকেই বলা হয় অক্ষমতা-অপারগতা। আবার কখনও সংশোধন ও সফলকাম হওয়ার ক্ষমতা রাখে, কিন্তু সে সফলকাম হতে ইচ্ছা করে না। এটিকেই বলা হয় আলস্য। এ দু’টি খারাপ অভ্যাসের কারণেই সকল প্রকার কল্যাণ ছুটে যায় এবং সকল অকল্যাণ চলে আসে। এই অকল্যাণের কারণেই মানুষ তার শারিরীক শক্তি থাকতেও তার দ্বারা উপকৃত হতে পারে না। এটিকেই বলা হয় কাপুরুষতা। এই কারণেই মানুষের সম্পদ থাকা সত্বেও তা দ্বারা উপকৃত হতে পারেনা। তা হচ্ছে কৃপণতা। এ থেকেই দু’টি কর্তৃত্ব তৈরী হয়। একটি হচ্ছে কারও হকের উপর নিজস্ব কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এটিই হচ্ছে ঋণের আধিক্য। আরেকটি হচ্ছে অন্যায়ভাবে মানুষের উপর অন্যায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। এটিই হচ্ছে মানুষের উপর দুষ্ট পুরুষদের প্রাধন্যতা ও কর্তৃত্ব। এই সবগুলোই অপরাগতা ও অক্ষমতার ফলাফল। এ অর্থেই সহীহ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সেই কথা ব্যবহৃত হয়েছে, যা তিনি এমন ব্যক্তির জন্য বলেছিলেন কোন এক বিচারে যার বিরুদ্ধে ফয়সালা করা হয়েছিল। এতে সেই লোকটি বলেছিলঃ

 حَسْبيَ اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ

 আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি আমার পক্ষে কাজ করার জন্য তিনিই উত্তম যিম্মাদার। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ আল্লাহ্ তাআলা অক্ষম ও অপারগ হওয়াকে দোষারূপ করেন। তোমার উচিৎ ছিল বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে কর্মঠ হওয়া এবং নিজের অধিকার আদায়ের জন্য চেষ্টা করা। চেষ্টা করার পরও যদি পরাজিত হয়ে যাও তখন বলঃ

 حَسْبيَ اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ

 আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি আমার পক্ষে কাজ করার জন্য তিনিই উত্তম যিম্মাদার। এই ব্যক্তি বিন্দু মাত্র চেষ্টা না করেই এবং বিবেক-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ না করেই কথাটি বলেছে। এতে করে বিচারে ফয়সালা বা রায় তার বিরুদ্ধে গিয়েছে। সে যদি স্বীয় হক প্রতিষ্ঠা করার জন্য চেষ্টা করত এবং যথাযথ দলীল-প্রমাণ পেশ করত, যুক্তি দিয়ে কথা বলত তাহলে রায় তার পক্ষে যেত। উপায়-উপকরণ অবলম্বন করার পর এবং বিজয়ী হওয়ার প্রচেষ্টা চালানোর পর পরাজিত হয়ে কথাটি বললে তা আসল স্থানে বলা হয়েছে বলে বিবেচিত হত। ইবরাহীম (আঃ) আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া থেকে বাঁচার জন্য সমস্ত উপায় ও কৌশল গ্রহণ করেছেন এবং কোন প্রচেষ্টাই তিনি বাদ দেন নি। অতঃপর যখন শত্রুরা তাঁর উপর জয়ী হয়ে গেল এবং তারা তাঁকে আগুনে নিক্ষেপ করল তখন তিনি বললেনঃ

 حَسْبيَ اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ

 আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি আমার পক্ষে কাজ করার জন্য তিনিই উত্তম যিম্মাদার। তাই তাঁর কথা যথাস্থানে প্রয়োগ হয়েছিল এবং তাঁর কথাটি বলার সাথে সাথেই ফল দিয়েছে।

 এমনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর সাহাবীগণকে উহুদ যুদ্ধ হতে ফিরে আসার পর যখন বলা হল যে,

 إِنَّ النَّاسَ قَدْ جَمَعُوا لَكُمْ فَاخْشَوْهُمْ

 “তোমাদের সাথে মোকাবেলা করার জন্য লোকেরা পরিপূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়েছে সুতরাং তাদের ভয় কর তখন সাহাবীগণও প্রস্ততি নিলেন। অতঃপর তারাও কাফেরদের মুকাবেলা করার জন্য বের হলেন এবং বললেনঃ

 حَسْبُنَا اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ

 “আমাদের জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট; আর আমাদের পক্ষ থেকে কাজের জন্য তিনিই উত্তম জিম্মাদার”। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৭৩) তাদের এই কথা সঠিক সময় ও সঠিক স্থানে হওয়ার কারণে পরিপূর্ণ প্রভাব ও ফলাফল দেখা দিয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

 وَمَن يَتَّقِ اللَّهَ يَجْعَلْ لَّهُ مَخْرَجاً وَيَرْزُقْهُ مِنْ حَيْثُ لا يَحْتَسِبُ

 “আর যে আল্লাহ্কে ভয় করে, আল্লাহ্ তার জন্যে নিস্কৃতির পথ করে দেবেন। এবং তাকে তার ধারণাতীত জায়গা থেকে রিযিক দেবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্যে তিনিই যথেষ্ট”। (সূরা তালাকঃ ২-৩) সুতরাং যে আল্লাহর উপর ভরসা করবে, আল্লাহ্ তার জন্য যথেষ্ট। এখানে তাকওয়ার পর তাওয়াক্কুল তথা ভরসার কথা বলা হয়েছে। তাকওয়া হচ্ছে আসবাব তথা এমন উপায়-উপকরণ অবলম্বন করা, যা গ্রহণ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। আর তা গ্রহণ করার পর ভরসা করলে আল্লাহ্ সাহায্য করবেন। আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ

 وَاتَّقُوا اللَّهَ وَعَلَى اللَّهِ فَلْيَتَوَكَّلِ المُؤْمِنُونَ

 “আল্লাহকে ভয় কর এবং মুমিনদের আল্লাহর উপরই ভরসা করা উচিত”। (সূরা মায়িদাঃ ১১)

 সুতরাং প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম ব্যয় করা ছাড়াই ভরসা করা এবং সাহায্যকারী হিসাবে আল্লাহকেই যথেষ্ট মনে করা শুধু অপরাগ-অক্ষমতারই নামান্তর। যদিও এখানে আল্লাহর উপর ভরসা করার বিষয়টি প্রস্ফুটিত হচ্ছে তথাপিও এটি হচ্ছে অক্ষম-অপারগতার তাওয়াক্কুল (ভরসা)। সুতরাং বান্দার উচিত নয় যে, সে তার ভরসাকে অক্ষমতায় পরিণত করে এবং অপারগতাকে ভরসায় পরিণত করে নেয়। বরং আল্লাহর উপর ভরসাকেও যেন ঐ সমস্ত উপায়-উপকরণ ও মাধ্যমের অন্তর্ভূক্ত মনে করে ,যার সবগুলো একসাথে ব্যয় না করলে লক্ষ্যবস্তু অর্জিত হয়না। এই মাসআলায় মানুষের দু’টি দল ভুল করেছে। একদল মনে করছে উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য শুধু আল্লাহর উপর ভরসাই যথেষ্ট। তাই তারা আল্লাহর নির্দেশিত কাজ সম্পাদন করা বর্জন করেছে, যা উদ্দেশ্যে পৌঁছার জন্য আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত মাধ্যম ছিল। সুতরাং তারা অলসতা ও অক্ষমতা-অপারগতার দোষে দুষিত হয়েছে। পরিশ্রম বিহীন ভরসাকে তারা শক্তিশালী মনে করার পরও আল্লাহর উপর তাদের ভরসা দুর্বল হয়েছে। যখনই পরিশ্রম বিহীন ভরসা শক্তিশালী হবে তখনই অলসতা তার কাজের স্পৃহাকে দুর্বল করে দিবে। যেই কর্মটি ছিল ভরসার মহল।

 যেই কৃষক জমিনে চাষ করে এবং তাতে বীজ বপন করে এবং ফসল উৎপন্ন হওয়াতে আল্লাহর উপর ভরসা করে সেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর উপর ভরসা করে এবং তাওয়াক্কুলের হক আদায় করে। সে জমিনকে পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে দিয়ে আল্লাহর ভরসাকে নষ্ট করে দেয়না। এ রকমই হওয়া উচিত পথ চলার সাথে সাথে মুসাফিরের ভরসা এবং আল্লাহর শাস্তি হতে রেহাই পাওয়া এবং তাঁর ছাওয়াব অর্জনের মাধ্যমে সফলকাম হওয়ার জন্য আল্লাহর আনুগত্যে সর্বদা শ্রম ব্যয় করার সাথে সাথে আল্লাহর উপর ভরসা করা। এটিই হচ্ছে ঐ তাওয়াক্কুল, যার ফলাফল পাওয়া যায় এবং এভাবে যারা আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহ্ তাদেরকে সাহায্য করেন। অলস ও অক্ষম ব্যক্তির ভরসা আদৌ কোন ফল বয়ে আনেনা। আল্লাহও তাকে সাহায্য করেন না।

 দ্বিতীয় বিভ্রান্ত দলটি হচ্ছে, যারা উপায়-উপকরণ ও পরিশ্রমের উপরই সম্পূর্ণরূপে ভরসা করেছে। তাদের (বাস্তববাদীদের) বিশ্বাস হল পরিশ্রমই একমাত্র সফলাতার চাবি। তারা আল্লাহর উপর ভরসা করা থেকে সম্পূর্ণ বিমুখ। এই দলটি যদিও উদ্দেশ্য অর্জনে প্রচুর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু তারা আল্লাহর উপর ভরসাকারীদের ন্যায় শক্তিশালী নয়, তাদের জন্য আল্লাহর সাহায্যও নেই এবং তাদের বিপদাপদও তিনি দূর করেন না। বরং আল্লাহর উপর ভরসা ছেড়ে দেয়ার কারণে এই দলটি দুর্বল ও অক্ষমে পরিণত হয়েছে।

 সুতরাং আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলেই (ভরসাতেই) প্রকৃত শক্তি। কোন কোন সালাফ বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সবচেয়ে অধিক শক্তিশালী হতে চায় সে যেন আল্লাহর উপর ভরসা করে। তাই আল্লাহর উপর ভরসাকারী শক্তিশালী হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত।

 মোটকথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বান্দাকে এমন বিষয়ের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, যাতে রয়েছে তার পরিপূর্ণ সফলতা এবং তার উদ্দেশ্য পূর্ণ হওয়ার গ্যারান্টি। সুতরাং এই সফলতা অর্জনের প্রচেষ্টা করা উচিত এবং এ জন্য শ্রম ব্যয় করা জরুরী। তাহলেই হাসবীয়াল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকীল বলা উপকারী হবে। কিন্তু যে অলসতা করবে এবং অক্ষমতা প্রকাশ করবে ও লক্ষ্যবস্তু অর্জনের সুযোগ চলে যাওয়ার পর

 حَسْبيَ اللَّهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ

 “আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি আমার পক্ষে কাজ করার জন্য তিনিই উত্তম যিম্মাদার” এ কথা বলবে, আল্লাহ্ তাআলা তার উপর অসন্তুষ্ট হবেন। এই অবস্থায় তাকে আল্লাহ্ সাহায্য করেন না। যে ব্যক্তি আমল করে, আল্লাহকে ভয় করে এবং তাঁর উপর ভরসা করে তিনি তাকেই সাহায্য করেন।

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন

No comments found.

New comment