কুরবানী ও আকীকার ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হেদায়াত - লিখেছেন আব্দুল্লাহ শাহেদ।

কুরবানী ও আকীকাহ সেই আট প্রকার পশুর দ্বারাই করতে হবে, যা সূরা আনআমে বর্ণিত হয়েছে। এ ছাড়া অন্যান্য জানোয়ার দিয়ে কুরবানী করার কথা প্রমাণিত নেই। এই আট প্রকার জন্তুর কথা কুরআনের চারটি আয়াতের মধ্যে উল্লেখ আছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
أُحِلَّتْ لَكُمْ بَهِيمَةُ الأنْعَامِ
“তোমাদের জন্যে চতুষ্পদ জন্তু হালাল করা হয়েছে”। (সূরা মায়েদাঃ ১) আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ
لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الأنْعَامِ
“যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ্র নাম স্মরণ করে তার দেয়া চতুষ্পদ জন্তু যবেহ্ করার সময়। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও”। (সূরা হাজ্জঃ ২৮) আল্লাহ্ তআলা বলেনঃ
وَمِنَ الأنْعَامِ حَمُولَةً وَفَرْشًا كُلُوا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللَّهُ وَلا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ
তিনি সৃষ্টি করেছেন চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে বোঝা বহনকারীকে এবং খর্বাকৃতিকে (ছোট আকৃতির জানোয়ার)। আল্লাহ্ তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন, তা থেকে খাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। (সূরা আনআমঃ ১৪২) আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ
وَمَنْ قَتَلَهُ مِنْكُمْ مُتَعَمِّدًا فَجَزَاءٌ مِثْلُ مَا قَتَلَ مِنَ النَّعَمِ يَحْكُمُ بِهِ ذَوَا عَدْلٍ مِنْكُمْ هَدْيًا بَالِغَ الْكَعْبَةِ
“তোমাদের মধ্যে যে জেনে শুনে শিকার বধ করবে, তার ওপর বিনিময় ওয়াজেব হবে, যা সমান হবে ঐ জন্তুর, যাকে সে বধ করেছে। দু’জন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি এর ফয়সালা করবে- বিনিময়ের জন্তুটি উৎসর্গ হিসেবে কাবায় পৌছাতে হবে”। (সূরা মায়েদাঃ ৯৫) এ তেকে জানা গেল যে, এই আট প্রকার জন্তুই কাবা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। এই আয়াত থেকে আলী বিন আবু তালেব এভাবেই দলীল গ্রহণ করেছেন।
এবাদতের জন্য যে সমস্ত যবাই করা হয়, তা তিন প্রকার। (১) হাজীগণের কুরবানী (হাদী)। (২) ঈদুল আযহার কুরবানী এবং (৩) আকীকাহ।
হজ্জের কুরবানী (হাদী) যবাইয়ের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হেদায়াতঃ
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্জের কুরবানীতে ছাগল ও উট যবাই করেছেন। তাঁর স্ত্রীদের পক্ষ হতে গরু কুরবানী করেছেন। তিনি মদীনাতে থাকা অবস্থায়, হজ্জের সফরে এবং উমরার সফরে হাদী (কুরবানী) প্রেরণ করেছেন। তিনি ছাগলের গলায় কেলাদা (কুরবানীর নিদর্শন হিসেবে মালা) পরাতেন। দাগ দিয়ে নিশানা লাগাতেন না। তিনি যদি কাবায় হাদী (কুরবানীর জানোয়ার) পাঠাতেন তাহলে তিনি নিজের উপর কোন হালাল বস্তুকেই হারাম মনে করতেন না। আর তিনি যখন কুরবানীর জন্য মক্কায় উট পাঠাতেন তখন উটের গলায় মালা পরাতেন এবং উটের গায়ে নিশানাও লাগাতেন। তিনি উটের কুঁজের ডান পাশে সামান্য চিড়ে রক্ত প্রবাহিত করতেন। তিনি যখন হাদী (কুরবানীর জন্তু) পাঠাতেন তখন প্রেরিত ব্যক্তিকে বলে দিতেন, জন্তুটি মরে যাওয়ার উপক্রম হলে সেটিকে যেন যবাই করে দেয়া হয়। অতঃপর স্বীয় জুতায় জন্তুটির রং মাখিয়ে যেন জন্তুর পৃষ্ঠদেশে রেখে দেয়া হয়। প্রেরিত ব্যক্তিকে আদেশ দিতেন যে, সে এবং তার সাথীগণ যেখান থেকে যেন কিছু না খায়। বরং অন্যদের মাঝে যেন তা বিতরণ করে দেয়া হয়। তাকে খেতে এই জন্য নিষে করা হয়েছে যে, যাতে পশুটির যত্ন নিতে সে যেন কোন প্রকার অলসতা না করে। অর্থাৎ এই সন্দেহ যাতে না হয় যে, অযত্ন ও অবহেলার কারণে পশুটি মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। ফলে সে যবাই করে নিজে এবং তার সাথীগণ গোশত খেয়ে নিয়েছে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি উট ও একটি গরুর মধ্যে সাতজনের অংশ গ্রহণকে বৈধ বলেছেন। কুরবানীর জন্তু মক্কার উদ্দেশ্য চালিয়ে নেয়ার সময় চালককে তার উপর আরোহন করার অনুমতি দিয়েছেন। তবে শর্ত হচ্ছে, যদি আরোহনের জন্য অন্য কোন বাহন না পাওয়া যায় এবং যাতে পশুর কষ্ট না হয়। আলী (রাঃ) বলেনঃ উটনীর যদি বাচ্চা থাকে এবং বচ্চা পান করার পর অবশিষ্ট দুধ পান করা চালকের জন্য জায়েয আছে।
বাম পা বেঁধে তিন পা-এর উপর খাড়া রেখে উটকে নহর করা (সামনের দু’পা বরাবর বুকে ধাঁরালো অস্ত্র ঢুকিয়ে রক্ত প্রবাহিত করা) তাঁর পবিত্র সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত ছিল। নহর করার সময় আল্লাহু আকবার বলতেন। তিনি নিজ হাতে কুরবানীর পশু যবাই করতেন। কখনও তিনি এই কাজের জন্য অন্য কাউকে নিয়োগ করতেন। তিনি যখন ছাগল যবাই করতেন স্বীয় ছাগলের চেহারার এক পার্শ্বে রাখতেন এবং বিসমিল্লাহ্ আল্লাহু আকবার বলে ছুরি চালাতেন। তিনি তাঁর উম্মতের জন্য হজ্জের ও ঈদের কুরবানীর গোশত খাওয়া বৈধ করেছেন এবং তা রেখে দিয়ে পরবর্তীতে সফর সামগ্রী হিসেবে সাথে বহন করার অনুমতি দিয়েছেন। একবার মদীনায় অভাব দেখা যাওয়ার কারণে তিনি দিনের বেশী জমা করে রাখতে নিষেধ করেছিলেন। কখনও তিনি কুরবানীর গোশত বিলিয়ে দিতেন। কখনও তিনি বলতেনঃ যে চায় সে যেন এ রকম করে এবং যে চায় সে যেন কেটে নিয়ে যায়। এ থেকে দলীল পাওয়া যায় যে, বিয়ের অলীমা, ঈদের দিন বা অন্য কোন অনুষ্ঠানে যে সমস্ত বস্তু সকলের জন্য ছিটিয়ে দেয়া হয় বা ফেলে রাখা হয় তা থেকে লুটে নেওয়া জায়েয। অনেকেই কুরবানীর গোশত ও বিবাহের অনুষ্ঠানে ছিটিয়ে রাখা বস্তু থেকে লুটে নেওয়ার মধ্যে পার্থক্য করেছেন। অথচ তা সঠিক নয়। তিনি উমরার হাদী (কুরবানী) মারওয়ার নিকট জবেহ করতেন আর হজ্জে কিরানের হাদী মিনাতে যবাই করতেন। হালাল না হয়ে তথা ইহরাম না খুলে তিনি কখনও কুরবানীর পশু যবাই করতেন না। সূর্য্য উদয়ের আগে এবং জামারায়ে কুবরায় পাথর নিক্ষেপ করার পূর্বে তিনি হাদী যবাই করেন নি। কুরবানীর দিন তথা যুল হাজ্জ মাসের ১০ তারিখে চারটি কাজ তিনি ধারাবাহিকভাবে করতেন। প্রথমে তিনি পাথর নিক্ষেপ করতেন, অতঃপর কুরবানী করতেন, অতঃপর মাথা মুন্ডাতেন এবং সর্বশেষে তাওয়াফ করতেন। সূর্য্য উঠার পূর্বে কুরবানীর করার অনুমতি দেন নি।

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন

No comments found.

New comment