পবিত্রতা অর্জন করার বিধান পর্ব-১ ( গোসল করা )

 

 

 
পবিত্রতা সম্পর্কিত কোরআন ও হাদীসের বর্ণনা
যে কোন প্রকার ইবাদত করার আগে পবিত্রতা (বা তাহারাত) অর্জন করা প্রয়োজন। আত্মিক পবিত্রতার সাথে বাহ্যিক পবিত্রতাও আবশ্যক। বাহ্যিক পবিত্রতার সাথে সাথে আত্মিক পবিত্রতাও সহজে আসে। ওযু করার পর মানুষের হৃদয়ে এক অব্যক্ত ভাব ও শান্তির উদ্ভব হয়, যা শুধু ওযুর মাধ্যমেই সম্ভব।
কোরআনে উল্লেখ রয়েছেঃ
“হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, তোমরা যখন সালাতের জন্যে দাঁড়াবে- তোমরা তোমাদের (পুরো) মুখমন্ডল ও কনুই পর্যন্ত তোমাদের হাত দুটো ধুয়ে নেবে, অতঃপর তোমাদের মাথা মাসেহ করবে এবং পা দুটো গোড়ালি পর্যন্ত (ধুয়ে নেবে,) কখনো যদি (এমন বেশী) নাপাক হয়ে যাও (যাতে গোসল করা ফরয হয়ে যায়), তাহলে (গোসল করে ভালভাবে) পবিত্র হয়ে নেবে, যদি তোমরা অসুস্থ হয়ে পড়ো কিংবা তোমরা যদি সফরে থাকো, অথবা তোমাদের কেউ যদি মলমুত্র ত্যাগ করে আসে অথবা যদি নারী সম্ভোগ করে থাকো (তাহলে পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করো), আর যদি পানি না পাও তাহলে পবিত্র মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করে নাও, (আর তায়াম্মুমের নিয়ম হচ্ছে, সেই পবিত্র) মাটি দিয়ে তোমরা তোমাদের মুখমন্ডল ও হাত মাসেহ করে নেবে; (মূলত) আল্লাহ তায়ালা কখনো (পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে) তোমাদের কষ্ট দিতে চান না, বরং তিনি চান তোমাদের পাক-সাফ করে দিতে এবং (এভাবেই) তিনি তোমাদের ওপর তাঁর নেয়ামতসমূহ পূর্ণ করে দিতে চান, যাতে করে তোমরা তাঁর কৃতজ্ঞতা আদায় করতে পারো।” {সূরা আল মায়িদা, আয়াত ৬}
উপরোক্ত আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহ আমাদেরকে অপবিত্রতা থেকে মুক্ত হয়ে পবিত্র হওয়া ফরয করেছেন যাতে তিনি আমাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করতে পারেন। অনুরূপ সূরা আন নিসার ৪৩ নং আয়াতের সারমর্ম হল, যতক্ষণ না পবিত্রতা অর্জন করা যায় ততক্ষণ সালাত আদায় নিষেধ।
এক হাদীসে বর্ণিত আছে, ইব্‌ন উমার (রা.) বলেছেন, “আমি আল্লাহর রসূল (স.)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘তাহরাত (বা পবিত্রতা) ব্যতিরেকে সালাত কবুল হয় না।” {মুসলিম, ইফা, ২য় খন্ড, হা/৪২৬, তিরমিযী, ইফা, ১ম খন্ড, হা/২,৩}
অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (স.) বলেছেন, “যেই মুসলিম ব্যক্তি ওযু করবে এবং ওযুকে সুন্দরভাবে সম্পাদন করবে, অতঃপর সালাত আদায় করবে সেই ব্যক্তির এই সালাত ও তার পূ্র্ববর্তী সালাতের মধ্যবর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” {মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/৪৩১; মিশকাত, এমদাদিয়া ২য় খন্ড, হা/২৬৬}
সুতরাং ইবাদত করার জন্য আল্লাহ পবিত্রতাকে প্রাথমিক শর্ত হিসাবে নির্দিষ্ট করেছেন। বিশেষ করে সালাত আদায় ও কুরআন তেলাওয়াত করতে ওযু, গোসল, তায়াম্মুম ইত্যাদি দ্বারা পবিত্রতা অর্জনকে শুধু ফরয বা বাধ্যতামূলকই করা হয়নি, বরং অপবিত্র অবস্থায় ইবাদাত করাকে কঠিন গুনাহ বলেও ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ওযু, গোসল, তায়াম্মুম করার জন্য প্রধানতঃ পানি ও মাটি ব্যবহৃত হয়। তবে শারীরিক পবিত্রতা অর্জনের জন্য যেহেতু পানি ব্যবহৃত হয় সেহেতু প্রথমে পানির পবিত্রতা সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক এবং তারপর পবিত্রতা সম্পর্কিত জরুরী বিষয়াদি সম্বন্ধে আলোচনা করা হবে (২য় পর্বে)।
 
পবিত্র পানির বর্ণনাঃ
(১) সমুদ্র, নদী, খাল-বিল, হ্রদ, জলাশয়, ঝর্ণা, পুস্করিণী, কুয়া, নলকূপ, বৃষ্টি, বরফ ইত্যাদির পানি সর্বদা পবিত্র। এই পানি দিয়ে অপবিত্রতা দূর এবং ওযু গোসল করা জায়েয (বৈধ)। {মুসলিম}
(২) শিলা ও বরফ গলা পানি পবিত্র, তবে জমাট বরফ দিয়ে ওযু করা জায়েয নয়।
(৩) গভীর পানিতে লতাপাতা, ঘাস ইত্যাদি পচে গেলে অথবা মাছ, ব্যাঙ, কাঁকড়া ও যে সমস্ত কীট-পতঙ্গ পানিতে জন্মে অথবা মশা, মাছি প্রভৃতি যাদের দেহে রক্ত হয় না সেগুলি পানিতে মরে পচে গেলেও পানি অপবিত্র হবে না। {আহমাদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ}
(৪) বিশুদ্ধ পানির কোন বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদ নেই। যে কোন কারণে বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদের কোন একটির ব্যতিক্রম ঘটলেই পানি অপবিত্র হয়ে যাবে। অবশ্য বালি, সাবান, কেওড়া, জাফরান, মাটি, পাথর, গোলাপ ইত্যাদি বস্তু মিশিয়ে পানির কোন অবস্থার পরিবর্তন ঘটালেও তা অপবিত্র হয়ে যাবে না।
(৫) কোন অপবিত্র বস্তু অথবা মৃতদেহ পড়ে পানির স্বাভাবিক অবস্থার কোন একটির পরিবর্তন ঘটলে পানি অপবিত্র হয়ে যায়। {ইবনে মাজাহ}
(৬) কোন স্থানে কমপক্ষে সোয়া ছয় মন পানি থাকলে এবং তাতে অপবিত্র বস্তু পড়লে যতক্ষণ পর্যন্ত তার গন্ধ, স্বাদ ও রং পরিবর্তন না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সে পানি অপবিত্র হবে না। {মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/৫৩৪; তিরমিযী, ইফা ১ম খন্ড, হা/৬৭; আহমাদ, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, হাদীস সহীহ} কিন্তু রং, স্বাদ ও গন্ধ যে কোন একটি বদলে গেলে সে পানি অপবিত্র হয়ে যাবে।
 
পানির ব্যবহারঃ
(১) পানি শারীরিক পবিত্রতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। রাসূল (স.) বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন ঘুম থেকে জেগে দু’হাতের কব্জি পর্যন্ত তিনবার না ধুয়ে পানির পাত্রে হাত না ডুবায়; কারণ তার জানা নেই যে ঘুমন্ত অবস্থায় তার হাত কোথায় কি অবস্থায় ছিল।” {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৬৩; তিরমিজী, ইফা ১ম খন্ড, হা/২৪} সুতরাং ঘুম থেকে জেগে উঠা ব্যক্তি ওযু করার পূর্বে প্রথমে তিনবার হাত ধুয়ে নিয়ে ওযুর পানির পাত্রে হাত ঢুকাবে।
(২) পানি পান করার সময় পাত্রের মধ্যে নিঃশ্বাস ছাড়া নিষেধ। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৫৫, ১৫৬}
(৩) পবিত্রতা অর্জনের জন্য পানির অভাব হলে বিজোড় সংখ্যক (কমপক্ষে তিনটি) পাথর বা মাটির ঢেলা ব্যবহার অপরিহার্য। তবে হাড় বা গোবর ব্যবহার করা যাবে না। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৫৭, ১৬২}
 
পেশাব-পায়খানাঃ
(১) পেশাব পায়খানার পর পবিত্রতা অর্জনের জন্য পানি ব্যবহার করতে হবে। {মুসলিম, ইফা, ২য় খন্ড হা/৫১০-৫১২}
(২) শুধু দুধ খায় এমন ছেলে শিশুর পেশাব লাগা কাপড়ে পানি ছিটিয়ে দিলেই পবিত্র হয়ে যায়। তবে মেয়ে শিশু হলে তা ধুয়ে নিতে হবে। {মুসলিম, ইফা, ২য় খন্ড, হা/৫৫৩-৫৫৬; তিরমিযী, ইফা ১ম খন্ড, হা/৭১}
(৩) মল-মূত্র কাপড় থেকে উত্তম ভাবে ধৌত না করে ঐ কাপড় পরে সালাত আদায় করলে সালাত আদায় হবে না এবং কবরে ভয়ানক আযাব হবে।
(৪) পেশাব অপবিত্র এবং এ থেকে নিজেকে রক্ষা না করলে পরকালে কবরেও এর জন্য কঠিন আযাব হবে। {মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/৫৬৮}
(৫) পেশাব পায়খানার স্থানে প্রবেশের সময় বাম পা আগে রেখে ঢুকা এবং বাম পায়ের উপর ভর দিয়ে বসা সুন্নাত। কা’বা শরীফের দিকে মুখ বা পিঠ করে পেশাব পায়খানা করা নিষেধ। ডান হাত দিয়ে ইস্তিঞ্জা (শৌচকার্য) করা নিষেধ। পেশাব পায়খানারত অবস্থায় কথাবার্তা বলা বর্জনীয়। {মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/৪৯৭, ৪৯৮; তিরমিযী, ইফা, ১ম খন্ড, হা/৮, ১৫, ১৬}
(৬) রাসূল (স.) যখন প্রকৃতির ডাকে শৌচাগারে যেতেন (যখন প্রবেশ করতেন) তখন বলতেনঃ
“আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযুবিকা মিনাল খুবুছি ওয়াল খাবাইছি”
‘হে আল্লাহ! আমি মন্দ কাজ ও শয়তান থেকে আপনার স্মরণ নিচ্ছি।’ {বুখারী, ইফা, ১ম খন্ড, হা/১৪৪}
(৭) কা’বা শরীফের দিকে মুখ বা পিঠ করে পেশাব পায়খানা করা নিষেধ। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৪৬} ডান হাত দিয়ে ইসতিন্‌জা (শৌচকার্য) করা নিষেধ। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৫৫}
(৮) মানুষ চলাচলের রাস্তায়, ফলবাগান ও ছায়াঘন গাছের নীচে এবং বসবাসের জায়গায় মলমুত্র ত্যাগ করা নিষেধ। {মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/৫০৯}
(৯) পেশাব পায়খানারত অবস্থায় ডান হাত দিয়ে গুপ্তাঙ্গ স্পর্শ করা নিষেধ। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৫৫, ১৫৬; মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/৫০৪-৫০৬}
(১০) পেশাব পায়খানার বেগ চেপে রেখে সালাত আদায় করা নিষেধ। {মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/১১২৬}
(১১) বদ্ধ বা স্থির পানিতে পেশাব করা নিষেধ। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/২৩৮, মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/৫৪৬}
(১২) যে সকল জানোয়ারের গোশত খাওয়া হালাল, সে সব জানোয়ারের পেশাব পায়খানা কাপড়ে বা শরীরে কিঞ্চিৎ লাগলে তাতে দোষ নেই। {তিরমিযী, ইফা ১ম খন্ড, হা/৭২}
দ্রষ্টব্যঃ
(১) পানির পরিবর্তে পেশাব পায়খানা হতে পবিত্র হবার জন্য যে কাপড়ের টুকরা, মাটির ঢেলা, পাথরের টুকরা ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় তাকে কুলুখ বলে।
(২) পেশাবের পর কুলুখ নিয়ে চলাফেরা বিদ’আত। পায়খানা করার পর ঢেলা ব্যবহার করে পানি দিয়ে ধোয়ার কথা যঈফ হাদীসে পাওয়া যায়। কিন্তু পেশাব করার পর পানি থাকা সত্ত্বেও কুলুখ ব্যবহারের কথা কোন হাদীসেই পাওয়া যায় না। তাই মওলানা আশরাফ আলী থানবী বলেন, “পেশাবের পর কুলুখ নিয়ে বেহায়ার মতো ঘোরাফেরা করো না।” ইমাম ইবনুল কাইয়িম বলেন, “পেশাবের পর জোরে জোরে কাশি দেয়া, উঠা বসা করা, পুরুষাঙ্গের ছিদ্র দেখা ও তার মধ্যে পানি দেওয়া যদি সুন্নাত হত তাহলে রাসূল (স.) ও সাহাবায়ে কিরাম নিশ্চয়ই করতেন এবং আমাদের শিক্ষা দিতেন।”
 
শরীর ও জিনিষের পরিচ্ছন্নতাঃ
(১) জুতায় নাপাকী (অপবিত্র বস্তু) লাগলে মাটিতে উত্তমরূপে ঘষলেই তা পবিত্র হয় যাবে। অনুরূপ নাপাক (অপবিত্র) জায়গা দিয়ে চলার কারণে যদি কোন মহিলার কাপড়ে নাপাকী লাগে সেক্ষেত্রে পবিত্র মাটির উপর দিয়ে চলার সময় কাপড়ের আচল মাটি স্পর্শ করলেই তা পবিত্র হয়ে যাবে।
(২) কোন জিনিসে অপবিত্রতা লাগলে সে অপবিত্র অংশটুকু উত্তমরূপে ধুয়ে নেয়াই যথেষ্ট। সম্পূর্ণ অংশ ধোয়া জরুরী নয়।
(৩) কোন পাত্রে কুকুর মুখ দিলে সে পাত্রটি সাতবার ধুতে হবে। প্রথমে বা শেষে উত্তমরূপে মাটি দিয়ে ঘষে মেজে পানি দিয়ে ধুয়ে নিলেই তা পবিত্র হয়ে যাবে। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৭৩; মুসলিম, ইফা, ২য় খন্ড, হা/৫৪২; তিরমিযী, ইফা ১ম খন্ড, হা/৯১}
(৪) বিড়ালের উচ্ছিষ্ট পবিত্র। বিড়াল কোন পানিতে মুখ দিলে সেই পানি দিয়ে ওযু ও গোসল করা জায়েয। {তিরমিযী, ইফা ১ম খন্ড, হা/৯২}
(৫) অপিবত্র বা জুনুবী (যৌনকর্ম বা বীর্যপাতের কারণে নাপাকী) অবস্থায় মসজিদে অবস্থান করা জায়েয নয়, তবে অতিক্রম করা যেতে পারে।
(৬) যে ঘরে কোন প্রাণীর ছবি ও কুকুর থাকে, সে ঘরে আল্লাহর রহমতের ফিরিশতা প্রবেশ করে না।
(৭) প্রতি সপ্তাহে গোঁফ ছাটা, নখ কাটা, বগল ও নাভীর নিচের লোম পরিস্কার করা সুন্নাত। তবে বগল ও নাভীর নীচের লোম পরিস্কার করার সর্বোচ্চ সময়সীমা ৪০ দিন।
 
স্বপ্নদোষ ও বীর্যপাতঃ
(১) পেশাবের পূর্বে কিংবা পরে যে গাঢ় সাদা পানি বের হয় তাকে অদী বলে। পেশাবের পর অদী বের হলে যৌনাঙ্গ ধুতে হবে এবং ওযু করতে হবে। গোসল করার প্রয়োজন নেই।
(২) যৌন উত্তেজনার সময় বিনা বেগে পেশাবের রাস্তা দিয়ে আঠা যুক্ত যে পানি বের হয় তাকে মযী বলে। কখনো বিনা অনুভূতিতেও এই পানি বের হতে পারে। মযী বের হলে ওযু ভেঙ্গে যায় বিধায় পুনরায় ওযু করতে হবে। কাপড়ের যে স্থানে লাগে তা এক আঁজলা পানি (দুই হাতের তালুতে যতটুকু পানি ধরে ততটুকু পানি) দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে এবং লজ্জাস্থান ধুয়ে ফেলতে হবে। কাপড়ে মযী (ধাতু) শুকিয়ে লেগে থাকলে তা খুঁটিয়ে ফেলে দিলে চলবে এবং ভেজা থাকলে ধুয়ে ফেলতে হবে।
(৩) উত্তেজনার চূড়ান্ত পর্যায়ে সবেগে যে তরল পদার্থ পেশাবের রাস্তা দিয়ে বের হয় তাকে মনী বা বীর্য বলে। বৈধ বা অবৈধ, যে কোন প্রকারেই সবেগে বীর্য বের হলে গোসল করা ফরয হয়ে যায়।
(৪) বীর্য মুক্ত কাপড় ধোয়ার পরও যদি দাগ পড়ে থাকে তাহলে তাতে ক্ষতি নেই। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/২২৯, ২৩০}
(৫) স্বামী স্ত্রী একাধিক বার মিলনের ইচ্ছা করলে মধ্যবর্তী সময়ে লজ্জাস্থান ধৌত করে ওযু করে নিলে চলবে।
 
হায়েয, নিফাস ও ইস্তেহাযাঃ
(১) বালেগা স্ত্রীলোকদের প্রত্যেক মাসের কয়েকদিন তাদের রেহেম (জরায়ু) হতে স্বাভাবিকভাবে যে রক্তস্রাব হয় তাকে মাসিক বা হায়েয বলে। কত বছর বয়সে এই রক্তস্রাব আরম্ভ হয় হাদীসে তার কোন উল্লেখ নাই। যে কয়দিন হায়েয থাকবে সে দিনগুলোর জন্য সালাত মাফ, কিন্তু হায়েয অবস্থায় রমযানের রোযা না রেখে অন্য মাসে তা আদায় করে নিতে হবে। {বুখারী ইফা, ১ম খন্ড, হা/৩০০} হায়েযের সাধারণ সময়সীমা পার হয়ে যাবার পরও রক্তস্রাব হতে থাকলে গোসল করে সালাত আদায় করতে হবে। {বুখারী ইফা, ১ম খন্ড, হা/৩০০, বর্ণনাকারী আয়েশা (রা.)}।
(২) হায়েয অবস্থায় কোরআন স্পর্শ করা, সালাত আদায় করা ও রোযা রাখা নিষেধ। তবে দু’আর নিয়তে কোন আয়াত পড়া, আল্লাহর যিকির, ইস্তিগফার, অযীফা করা জায়েয। তাদের জন্য কোরআন মুখস্ত পাঠ করাও জায়েয আছে। তবে উত্তমের খেলাফ বলা যেতে পারে। উল্লেখ্য যে, হায়েযে আক্রান্ত মহিলার কোরআন পাঠ নিষিদ্ধকারী একটি হাদীসও সহীহ সনদে প্রমাণিত নয়।
(৩) হায়েয অবস্থায় সহবাস করা হারাম। তবে হারাম জেনে অধৈর্য হয়ে সহবাস করলে লাল রক্ত প্রবাহের সময় (প্রথম দিকে) হলে এক দিনার এবং হলুদ রক্ত (শেষ দিকে) প্রবাহের সময় আধা দিনার কাফফারা দিতে হবে ও খাঁটি তওবা করতে হবে।
(৪) হায়েয অবস্থায় স্বামীর সাথে এক বিছানায় শোয়া ও অন্যান্য সাংসারিক কাজ সম্পন্ন করা যাবে।
(৫) স্ত্রীলোকের সন্তান প্রসবের পর যে রক্তস্রাব হয় তাকে নিফাস বলে। হায়েয অবস্থায় স্ত্রীলোকদের সঙ্গে যে সব কাজ করা নিষিদ্ধ, নিফাস অবস্থাতেও সে সবই নিষিদ্ধ। নিফাসের সময়ও সালাত মাফ হয়ে যায় কিন্তু রোযা মাফ হয় না, পাক হবার পর বাদ যাওয়া রোযা পালন করতে হবে। নিফাসের সর্বোচ্চ সময়সীমা ৪০ দিন। নিফাসের রক্তপাত বন্ধ হওয়া মাত্রই গোসল করে সালাত আদায় এবং রোযা রাখতে হবে।
(৬) হায়েয ও নিফাস ব্যতীত স্ত্রীলোকের অন্যান্য সময় রক্তস্রাব হলে তাকে ইস্তেহাযা (প্রদর) বলে। মুস্তাহাযা (যারা ইস্তেহাযা হয়েছে) স্ত্রীলোক পবিত্র স্ত্রীলোকের মত। ইস্তেহাযার ক্ষেত্রে অন্যান্য মাসের নিয়মিত দিনগুলোর সংখ্যা বাদ দিয়ে গোসল করে পবিত্র হয়ে সালাত আদায়, সিয়াম পালন ইত্যাদি ইবাদাত করতে হবে। ইস্তেহাযা অবস্থায় প্রত্যেক সালাতের আগে গোসল করা ভালো। নতুবা এক গোসলে দুই সালাত একত্রে আদায় করা যায়। তবে এই হুকুম ওয়াজিব নয়। সন্তান প্রসবের পর মেয়েদের রক্ত ঝরার মেয়াদের (সর্বোচ্চ ৪০ দিন) পরও রক্ত ঝরতে থাকলে গোসল করে সালাত আদায় করতে হবে।
 
গোসলঃ
অপবিত্রতা দূর করার জন্য শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ভালভাবে ধোয়াকে শরীয়ত মতে গোসল বলে। গোসল তিন প্রকার, যথা (১) ফরয, (২) সুন্নাত অথবা মুস্তাহাব (যা করলে অনেক সাওয়াব কিন্তু না করলে গুনাহ নেই) এবং (৩) মুবাহ (যা করলে সাওয়াব নেই এবং না করলে গুনাহ নেই)।
 
গোসল ফরয হবার কারণঃ
স্বামী-স্ত্রীর মিলনে, স্বপ্নদোষে বীর্যপাত হলে (স্বপ্নের কথা স্মরণ থাকুক বা না থাকুক শরীরে, কাপড়ে বা বিছানায় বীর্যের চিহ্ন দেখতে পেলে), মেয়েদের হায়েয ও নেফাসের রক্ত বন্ধ হলে, নিদ্রিত হোক বা জাগ্রত অবস্থায় হোক কামভাবে বীর্য বের হলে এবং কেউ ইসলাম গ্রহণকালে অপবিত্র থাকলে গোসল ফরয হয় (মিশকাত)।
 
সুন্নাত/মুস্তাহাব গোসলঃ
(১) জুমার সালাত, (২) ঈদের সালাত ও (৩) হজ্জ্ব বা ওমরাহ করার জন্য ইহরাম বাঁধার পূর্বে, (৪) আরাফার দিন দুপুরের পর, (৫) ইসলাম গ্রহণকালে অপবিত্র না থাকলে (মিশকাত) গোসল করা সুন্নাত। (৬) মোস্তাহাযা মহিলা (যে মহিলার প্রদর হয়েছে) প্রত্যেক সালাতের জন্য বা যোহর ও আসর মিলে এক গোসল এবং মাগরিব ও এশার জন্য আর একটি গোসল এবং ফজরের জন্য আলাদা গোসল করা সুন্নাত। (৭) অজ্ঞান হবার পর আবার জ্ঞান ফিরে পেলে গোসল করা সুন্নাত, (৮) মুশরিককে (আল্লাহর ইবাদতের সাথে অন্য কিছু শরীককারী) দাফন করে গোসল করা সুন্নাত (তামামূল মিন্নাহ) এবং (৯) মক্কায় প্রবেশের জন্য গোসল করা সুন্নাত। (১০) মুর্দাকে গোসলদানের পর গোসল করা মুস্তাহাব। (১২) ডান দিক থেকে গোসল শুরু করা সুন্নাত। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৬৮; মুসলিস, ইফা ২য় খন্ড, হা/৫০৭, ৫০৮}
 
মুবাহ গোসলঃ
ধূলাবালি ও ময়লা থেকে শরীর রক্ষা করার জন্য, গরমের তাপ থেকে শরীর ঠান্ডা রাখার জন্য, শ্রান্তি ও ক্লান্তি দূর করার জন্য গোসল করা মুবাহ।
 
গোসলে তিন ফরযঃ
গোসলের মধ্যে তিনটি ফরয যথা; (১) গড়গড়ার সাথে কুলি করা (তবে রোযাদার ব্যক্তিকে গড়গড়া করতে হবে না), (২) নাকের ভিতর পানি দিয়ে পরিস্কার করা এবং (৩) সমস্ত শরীরের পশমের গোড়ায় পানি পৌঁছে দেয়া অর্থাৎ সমস্ত শরীর ধৌত করা। এ তিনটির কোন একটি ছুটে গেলে গোসল হবে না।
 
গোসলের পদ্ধতি সম্পর্কিত কয়েকটি হাদীসঃ
(১) ইবনে গিয়াস (র.) … মায়মূনা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী (স.) এর জন্য গোসলের পানি রাখলাম এবং কাপড় দিয়ে পর্দা করে দিলাম। তিনি দু’হাতের উপর পানি ঢেলে উভয় হাত ধুয়ে নিলেন। তারপর ডান হাত দিয়ে বাম হাতে পানি ঢেলে লজ্জাস্থান ধুলেন। পরে হাতে মাটি লাগিয়ে ঘষে নিলেন এবং ধুয়ে ফেললেন। এরপর কুলি করলেন, নাকে পানি দিলেন, চেহারা ও দু’হাত (কনুই পর্যন্ত) ধুলেন। তারপর মাথায় পানি ঢাললেন ও সমস্ত শরীরে পানি পৌঁছালেন। তারপর একটু সরে গিয়ে দু’পা ধুয়ে নিলেন। এরপর আমি তাঁকে একটি রুমাল দিলাম কিন্তু তিনি তা দিয়ে শরীর মুছলেন না। তিনি দু’হাত ঝাড়তে ঝাড়তে চলে গেলেন। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/২৫৭}
(২) ইবনে মাহবুব (র.) … মায়মূনা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (স.) জানাবাতের গোসলের জন্য (যৌনকর্ম বা বীর্যপাতের কারণে গোসলের জন্য) পানি রাখলেন। তারপর দু’বার বা তিনবার ডান হাতে বাম হাতের উপর পানি ঢাললেন এবং তাঁর লজ্জাস্থান ধুলেন। তারপর তাঁর হাত মাটিতে … … অবশেষে সেখান থেকে একটু সরে গিয়ে তাঁর দু’পা ধুয়ে ফেললেন। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হ্/২৬৩, ২৬৪}
(৩) খাল্লাদ ইবনে ইয়াহইয়া (রা.) … আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমাদের কারও জানাবাতের গোসলের প্রয়োজন হলে দু’হাতে পানি নিয়ে তিনবার মাথায় ঢালতাম। পরে হাতে পানি নিয়ে ডান পাশে তিনবার এবং আবার অপর হাতে পানি নিয়ে বাম পাশে তিনবার ঢালতাম।
(৪) আয়েশার (রা.) বর্ণনায় আছে যে, প্রথমে রাসূল (স.) দুই হাত ধোবার পর সালাতের ওযুর মত ওযু করতেন। তারপর ভিজে হাত দিয়ে মাথার চুলগুলো খেলাল করতেন, তারপর মাথায় তিন আঁজলা পানি দিয়ে সর্বাঙ্গ ধুতেন।
(৫) আয়েশা (রা.) বলেন, রাসূল (স.) ফরয গোসলের পর আর ওযু করতেন না {তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ প্রভৃতি}। বরং গোসলের শুরুতে যে ওযু করতেন সেটাকেই যথেষ্ট মনে করতেন। তবে গোসলের শেষ দিকে ঐ ওযু যদি নষ্ট হয়ে যায় বা কাপড়ের ভিতর দিয়ে লজ্জাস্থানে হাত লেগে যায় তাহলে আবার ওযু করতে হবে।
 
ফরয গোসলের নিয়মঃ
(১) প্রথমে উভয় হাত তিনবার ভাল ভাবে ধুয়ে নিতে হবে।
(২) অতঃপর ডান হাত দিয়ে বাম হাতে পানি ঢেলে লজ্জাস্থান (ও যেসব জায়গায় নাপাকী লেগে আছে) ভালভাবে ধোবার পর মাটিতে ঘষে বা সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
(৩) তারপর পা ধোয়া বাকী রেখে সালাতের ওযুর ন্যায় ওযু করতে হবে। তবে মাথা মাসেহ করতে হবে না; বরং মাথায় পানি ঢেলে দেয়াই যথেষ্ট। হাফেজ ইবনে হাজার বলেন, আমি রাসূল (স.) এর ফরয গোসল সংক্রান্ত কোন হাদীসে ওযুর সময় রাসূল (স.) এর মাথা মাসেহ করার কথা পাইনি (ফাতহুল বারী)। এই জন্য মালেকী মাযহাবের লোকেরা এর থেকে দলিল গ্রহণ করেছেন এই মর্মে যে, জানাবাতের ফরয গোসলের ক্ষেত্রে মাথা মাসেহ করা বিধি সম্মত নয়। ইমাম আবু দাউদ, ইমাম আহমদকে এই প্রশ্নটি করেছিলেন, “ফরয গোসলের ওযুতে জুনুবী ব্যক্তি মাথা মাসেহ করবে কি?” তিনি বলেছিলেন, “সে মাথা মাসেহ করবে কেন, সে তো মাথায় পানিই ঢেলে দিয়েছে।” (মাসায়েলে ইমাম আহমদ)। ইমাম নাসাঈ এই জন্যই তার সুনান গ্রন্থে “জানাবাতের ওযুতে মাথা মাসাহ পরিত্যাগ করণ” শীর্ষক অধ্যায়ে যে হাদীসটি উল্লেখ করেছেন তার অংশ বিশেষ হল, এমনি কি যখন তিনি মাথার পর্বে পৌঁছিলেন তখন তিনি মাথা মাসেহ না করে তাতে পানি ঢাললেন {নাসাঈ}। আলবানী হাদীসটির সনদ সহীহ বলেছেন। সূত্রঃ নাসায়ে নববী (উর্দূ) এবং তাখরীজে সালাতুর রাসূল (উর্দূ)।
(৪) তারপর তিনবার মাথায় পানি ঢেলে চুলের গোড়ায় আঙ্গুল চালিয়ে মাথার চুলগুলো ভালভাবে নেড়েচেড়ে ধুতে হবে এবং সমস্ত শরীর ঘষে মেজে এমনভাবে গোসল করতে হবে যেন কোথাও এক লোককূপ পরিমাণ স্থানও শুকনো না থাকে। পানিতে ডুব দিয়েও গোসল করা যায়।
(৫) পরিশেষে গোসলের স্থান থেকে সরে গিয়ে পা ধুয়ে নিতে হবে।
(৬) কাপড় দিয়ে শরীর না মুছাই ভাল তবে কখনো ইচ্ছা করলে মুছা যেতে পারে।
(৭) গোসলের পর যদি শরীরের কোন জায়গা শুকনো থেকে যায় তাহলে সেই শুকনো জায়গাটা ভিজে হাত বুলিয়ে নিলে যথেষ্ট হবে, পুনরায় গোসল করতে হবে না।
(৮) স্ত্রীলোকদের চুল খোপা বাঁধা অথবা বেণী গাঁথা থাকলে তা গোসলের সময় খোলার প্রয়োজন নেই। আটঁ সাট অলংকার এবং ঐ সব অলংকার যা ছিদ্র করে পরা হয় যেমন নাকের বালি, কানের রিং বা দুল ইত্যাদি থাকলে সে সব নাড়িয়ে চাড়িয়ে তার নীচে এবং ছিদ্রের মধ্যে পানি পৌঁছাতে হবে।
দ্রষ্টব্যঃ ফরয গোসলের পর দ্বিতীয় বার ওযু করার কোন প্রয়োজন নেই।
 
~~~সমাপ্ত~~~
 
“আমার নামায কি শুদ্ধ হচ্ছে!”
গ্রন্থ থেকে মুমিন ভাই-বোনদের উপকারার্থে এখানে প্রকাশিত হলো। 

মন্তব্য করুন

No comments found.

New comment