পবিত্রতা অর্জন করার বিধান পর্ব-২ ( ওযু করা )

 

 

 
ওযু (১ম ভাগ)
ইবাদতের উদ্দেশ্যে শরীয়তের বিধান মতে পবিত্র পানি দিয়ে কতিপয় বিশেষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধৌত করাকে ওযু বলে। ওযু দুই প্রকার, যথাঃ (১) ফরয ওযু- যা সালাত আদায়ের জন্য করা হয় এবং (২) সুন্নাত ওযু- যা কোরআন তেলাওয়াত, পবিত্র থাকা ও গোসল করার জন্য করা হয়।
ওযু সম্বন্ধে কোরআন-এর বাণী
আল্লাহ বলেছেন,
“ইয়া আইয়্যুহাল্লাজীনা আমানু ইজা ক্বুমতুম ইলাস সালাতি ফাগ্‌ছিলু উজুহাকুম ওয়া আইদিয়াকুম ইলাল মারাফিকি ওয়ামছাহু বিরুয়ুছিকুম ওয়া আরজুলাকুম ইলাল কা’বাইন।”
“হে ঈমানদার ব্যক্তিরা, তোমরা যখন সালাতের জন্যে দাঁড়াবে- তোমরা তোমাদের (পুরো) মুখমন্ডল ও কনুই পর্যন্ত তোমাদের হাত দুটো ধুয়ে নেবে, অতঃপর তোমাদের মাথা মাসেহ করবে এবং পা দুটো গোড়ালি পর্যন্ত (ধুয়ে নেবে,)” {সূরা আল মায়িদা, আয়াত ৬}
 
ওযু সম্বন্ধে কয়েকটি হাদীসঃ
(১) ওযু শুরু করার পূর্বে ‘বিসমিল্লাহ’ বলতে হবে। হাদীসে এসেছে রাসূল (স.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর নাম নেবে না, তার ওযু হবে না।” {তিরমিযী, ইফা ১ম খন্ড, হা/২৫}
(২) আবু আবদুল্লাহ বুখারী (র.) বলেন, নবী (স.) বর্ণনা করেছেন, ওযুর ফরয হল এক-একবার করে ধোয়া। তিনি দু-দুবার করে এবং তিন-তিনবার করেও ধৌত করেছেন, কিন্তু তিনবারের বেশী ধৌত করেননি। পানির অপচয় করা এবং নবী (স.) এর আমলের সীমা অতিক্রম করাকে উলামায়ে কিরাম মাকরূহ বলেছেন। {বুখারী, ইফা, ১ম খন্ড, ৯৬ পরিচ্ছেদ}
(৩) ইসহাক ইবনে ইবরাহীম আল-হানাযালী (র.) … … আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলতেন, রাসূলুল্লাহ (স.) বলেছেন, যে ব্যক্তির হাদস হয় তার সালাত কবুল হবে না, যতক্ষণ না সে ওযু করে। হাযরা-মাওতের এক ব্যক্তি বলল, হে আবু হুরায়রা, হাদস কী? তিনি বললেন, নিঃশব্দে বা স্বশব্দে বায়ু বের হওয়া। {বুখারী, ইফা, ১ম খন্ড, ৯৭ পরিচ্ছেদ, হা/১৩৭}
(৪) ইয়াহইয়া ইবনে বুকায়র (র.) … … নু’আয়ম মুজমির (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আবু হুরায়রা (রা.) এর সঙ্গে মসজিদের ছাদে উঠলাম। তারপর তিনি ওযু করে বললেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (স.)-কে বলতে শুনেছি, কিয়ামতের দিন আমার উম্মাতকে এমন অবস্থায় ডাকা হবে যে, ওযুর প্রভাবে তাদের হাত-পা ও মুখমন্ডল থাকবে উজ্জ্বল। তাই তোমাদের মধ্যে যে এ উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে নিতে পারে, সে যেন তা করে।” {বুখারী, ইফা, ১ম খন্ড, ৯৮ পরিচ্ছেদ, হা/১৩৮}
(৫) আলী (রা.) … … আব্বাদ ইবনে তামীম (রা.)-এর চাচা থেকে বর্ণিত একবার রাসূলুল্লাহ (স.) এর কাছে এক ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হল যে, তার মনে হয়েছিল যেন সালাতের মধ্যে কিছু হয়ে গিয়েছিল। তিনি বললেন, সে যেন ফিরে না যায়। যতক্ষণ না শব্দ বা গন্ধ পায়। {বুখারী, ইফা, ১ম খন্ড, ৯৯ পরিচ্ছেদ, হা/১৩৯}
(৬) আবদুল্লাহ ইবনে ইউসুফ (র.) … … ইয়াহইয়া আল-মাযিনী (র.) থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রা.)-কে (তিনি আমর ইবনে ইয়াহইয়ার দাদা) জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কি আমাদেরকে দেখাতে পারেন, কিভাবে রাসূলুল্লাহ (স.) ওযু করতেন?” আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রা.) বললেন, ‘হ্যাঁ’। তারপর তিনি পানি আনলেন। হাতের উপর পানি ঢেলে দু’বার হাত ধুলেন। তারপর কুলি করলেন এবং তিনবার নাকে পানি দিয়ে ঝেড়ে পরিস্কার করলেন। এরপর চেহারা তিনবার ধুলেন। তারপর দু’হাত কনুই পর্যন্ত দু’বার করে ধুলেন। তারপর দু’হাত দিয়ে মাথা মাসেহ করলেন। অর্থাৎ হাত দুটি সামনে এবং পিছনে নিলেন। মাথার সম্মুখ থেকে শুরু করে উভয় হাত গর্দান পর্যন্ত নিলেন। তারপর আবার যেখান থেকে নিয়েছিলেন, সেখানেই ফিরিয়ে আনলেন। তারপর দু’পা ধুলেন। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৮৫; মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/৪৪৬} [এই হাদীসটি থেকে সমর্থন পাওয়া যায় যে রাসূল (স.) কোন অঙ্গ এক বার বা দুই বার বা তিন বার ধুয়েছেন।]
 
ওযু (২য় ভাগ)
রাসূল (স.) যেভাবে ওযু করতেন (১ম কিস্তি)
(১) রাসূল (স.) অধিকাংশ সালাতেই নতুন ওযু করে নিতেন। কখনও এক ওযুতে কয়েক ওয়াক্ত সালাত পড়তেন। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৯০}
(২) কখনও তিনি এক ‘মুদ’ (প্রায় এক সের) পানি দিয়ে ওযু করতেন। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/২০১} ওযু করতে গিয়ে ভালভাবে পানি ব্যবহার করতেন। তিনি উম্মতদের পানি খরচের ব্যাপারে অপব্যয় থেকে বাঁচতে বলেছেন। একবার তিনি সাদ (রা.) এর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি তখন ওযু করছিলেন। রাসূল (স.) বললেন, “পানির অপব্যয় করো না।” তিনি জবাব দিলেন, পানিতেও অপব্যয় হয়? রাসূল (স.) জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, তুমি যদি একটা প্রবাহিত নদীর তীরে বসেও ওযু কর, তথাপি হয়।”
(৩) রাসূল (স.) অবস্থা ভেদে একবার করে, দুবার করে এবং তিনবার করে অঙ্গ ধুতেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি একই ওযুতে কোন অঙ্গ দুবার এবং কোন অঙ্গ তিনবার ধুয়েছেন। তবে ওযুতে রাসূল (স.) কোন অঙ্গ তিনবারের বেশী ধুয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না।
(৪) রাসূল (স.) কখনও এক আঁজল পানি দিয়ে কুলি ও নাকে পানি দুটোই সারতেন। এক আঁজল পানি থেকে অর্ধেক দিয়ে কুলি করতেন ও বাকী অর্ধেক দিতেন নাকে, কিন্তু কুলি ও নাকে পানি আলাদা ভাবে করেছেন, তা কোন সহীহ হাদীসে পাওয়া যায় না। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৯০}
(৫) রাসূল (স.) ডান হাতে নাকে পানি দিতেন ও বাম হাতে পরিস্কার করতেন এবং পুরো মাথা মুছতেন। কখনও সামনে থেকে মুছে পিছনে আবার পিছন থেকে সামনে হাত নিতেন।
দ্রষ্টব্যঃ এ থেকেই কেউ দু’বার মাথা মুছার কথা বলেন। উপরে বর্ণিত হাদীস থেকে দেখা যায় যে, রাসূল (স.) অন্যান্য অঙ্গ তিনবার ধুতেন, কিন্তু মাথা একবারই মুছতেন। আল্লামা হাফিজ ইবনে কাইয়িম তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘যাদুল মাআদ’, প্রথম খন্ডের দ্বিতীয় অধ্যায়ে হযরতের পবিত্রতা অর্জন পদ্ধতি বর্ণনা করতে যেয়ে উল্লেখ করেছেন, “এ থেকেই কেউ দুবার মুছার কথা বলেন। তবে একবারই সঠিক। অন্যান্য অঙ্গ তিনবার ধুতেন এবং মাথা একবারই মুছতেন। হযরত (স.) থেকে এটাই সুস্পষ্ট প্রমাণিত। এর ব্যতিক্রম যা কিছু পাওয়া যায় তা সহীহ নয়। উসমান ও ইবনুল ইয়ামানীর হাদীসে তিনবার যে মুছার বর্ণনা রয়েছে তা ভুল বর্ণনা। আবু দাউদ বলেন, উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীসে একবার মুছাই রয়েছে। কোন সহীহ হাদীসে হযরতের (স.) আংশিক মুছার প্রমাণ নেই। … … … কুলি ও নাকে পানি ছাড়া তিনি কখনও ওযু করেছেন বলে প্রমাণ নেই। তেমনি তিনি ওযুতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। তার বিপরীত কখনও কেউ তাঁকে করতে দেখেনি।”
আল্লামা হাফিজ ইবনুল কাইয়িম রচিত ও আবদুস শহীদ নাসিম কর্তৃক বাংলায় অনূদিত ‘আল্লাহর রসূল কিভাবে নামায পড়তেন’ শীর্ষক পুস্তকের ২০ পৃষ্ঠায় মাথা মাসেহ সম্বন্ধে নিম্নরূপ উল্লেখ রয়েছেঃ
“তিনি পুরো মাথা মাসেহ করতেন। কপালের দিক থেকে আরম্ভ করে পিছনের দিকে আবার পিছনের দিক থেকে সামনের দিকে মাসেহ করতেন। এরকম করার কারণে কেউ কেউ বর্ণনা করেছেন, তিনি দু’বার মাসেহ করতেন। আসলে তিনি মাথা একবারই মাসেহ করতেন। অন্যান্য অঙ্গ একাধিকবার ধুতেন, কিন্তু মাথা একবারই মাসেহ করতেন। একথাই অকাট্যভাবে প্রমাণিত, এর ব্যতিক্রম কথা সহীহ নয়। ইবনুল ইয়ামানী তার পিতার সূত্রে হযরত উমার (রা.) থেকে তিনবার মাসেহ করার যে হাদীস বর্ণনা করেছেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ তারা বাপ-বেটা দু’জনই জঈফ বর্ণনাকারী, যদিও বাপের অবস্থা কিছুটা ভাল।
আবু দাউদে হযরত উসমান (রা.)-এর সূত্রে তিনবার মাসেহ করার যে বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি হযরত উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত সমস্ত সহীহ হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। তার থেকে বর্ণিত বিভিন্ন সহীহ হাদীসে একবার মাসেহ করার কথাই উল্লেখ হয়েছে।”
মোহাম্মদ মতিউর রহমান মোহাম্মাদী সালাফী কর্তৃক সঙ্কলিত ‘তরীকায়ে মোহাম্মদীয়া’, শীর্ষক পুস্তকের প্রথম খন্ডে মাথা মাসেহ করা প্রসঙ্গে উল্লেখ করে এক জায়গায় লিখেছেন, “… … … আর ইমাম বুখারী স্বীয় বুখারীর ১ম খন্ডের ৩১ পৃষ্ঠায় বলিয়াছেন যে, ইমাম মালিক (র.)-কে কেহ জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, মাথার কিছু অংশ মাসেহ করিলে যথেষ্ট বা জায়েয হইবে কি? তাহাতে তিনি আবদুল্লাহ বিন যায়েদ (রা.)-এর হাদীস হইতে প্রমাণ উদ্ধৃত করিয়া বলিলেন যে, সমস্ত মাথা মাসেহ করিতে হইবে।” ইমাম বুখারী (র.)-ও উপরোক্ত হাদীস এবং আয়াত উল্লেখ করিয়াছেন। আমরা তাহার কিছু অংশ উদ্ধৃত করিয়া তরজমা করিয়া দিতেছিঃ
তরজমাঃ “তারপর দুই হস্ত দ্বারা (হযরত) স্বীয় মাথা মাসেহ করিলেন। অতঃপর হস্তদ্বয় সামনের দিক হইতে পশ্চাদ্দিকে লইয়া গেলেন। মাথার সামনের দিক হইতে আরম্ভ করিয়া স্বীয় গর্দান পর্যন্ত লইয়া গিয়া সেখান হইতে পুনরায় যেখান হইতে আরম্ভ করিয়াছিলেন সেইখানে হস্তদ্বয় ফিরাইয়া আনিলেন।”
অতএব সমস্ত মাথাই মাসেহ করিতে হইবে নতুবা ফরয আদায় হইবে না।”
অন্যদিকে রাসূল (স.) থেকে তিন বার মাথা মাসেহ করারও উল্লেখ পাওয়া যায়। এ সম্বন্ধে আলোচনা নিম্নরূপঃ
আলবানী বলেন, “উসমান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (স.) মাথা তিনবার মাসেহ করেছেন। হাদীসটি আবু দাউদ দু’টি হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন। অত্র হাদীসের তৃতীয় আরেকটি হাসান সনদ রয়েছে। আমি এই সনদগুলির চুলচেরা আলোচনা করেছি সহীহ আবু দাউদে হা/৯৫, ৯৮।” হাফেয ইবনে হাজার ‘ফাতহুল বারী’তে বলেন, “আবু দাউদ হাদীসটিকে দু’টি সনদে (সূত্রে) বর্ণনা করেছেন, যার একটি সূত্রকে ইমাম ইবনে খুযায়মাহ প্রমুখ সহীহ বলেছেন অর্থাৎ উসমান (রা.)-এর হাদীস যেখানে তিনবার মাথা মাসেহ করার কথা আছে। এই হাদীসের বাড়তি মাথা মাসেহ এর কথা যেহেতু নির্ভরযোগ্য। হাফেজ ইবনে হাজার ‘তালখীছুল হাবীর’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, “ইবনুল জাওযী একের অধিকবার মাথা মাসেহ করাকে বিশুদ্ধ বলার দিকে ঝোঁক দিয়েছেন। আর এটাই হক কথা। কারণ উভয় প্রকার হাদীসে মূলতঃ কোন প্রকার দ্বন্দ্ব নেই কারণ সুন্নাত কাজ কোন সময় করা হয়, কোন সময় করা হয় না।” ইমাম সানআনীও তিনবার মাথা মাসেহ করার পক্ষে রায় দিয়েছেন। (তথ্য সূত্রঃ তামামুল মিন্নাহ)। ইমাম শাফেয়ী বহুপূর্বেই তিনবার মাথা মাসেহ করাকে মুস্তাহাব বলেছেন।
 
ওযু (৩য় ভাগ)
রাসূল (স.) যেভাবে ওযু করতেন (শেষ কিস্তি)
(৬) আল্লামা হাফেয ইবনে কাইয়িম তার রচিত ‘যাদুল মাআদ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “কুলি ও নাকে পানি ছাড়া রাসূল (স.) কখনও ওযু করেছেন বলে প্রমাণ নেই। তিনি ওযুতে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতেন। একবারও তারতীবের খেলাপ করেছেন বলে প্রমাণ নেই।” অপর দিকে আহমাদ ও আবু দাউদ এর বর্ণিত হাদীসে রাসূল (স.) বিনা ধারাবাহিকতায়ও ওযু করেছেন বলে উল্লেখ রয়েছে। {আহমাদ, ৪/১৩২; আবু দাউদ, ১/১২৫; হাদীসটির সনদ সহীহ}। ইমাম শাওকানী বলেন, “এই সনদ গ্রহণযোগ্য”। ইমাম আলবানীও হাদীসটিকে সহীহ প্রমাণ করেছেন {সহীহ আবু দাউদ, নুযুমুল ফারায়িদ, ১/২৬১}। হানাফী অভিমত অনুযায়ীও ওজুতে তারতীব (ধারাবাহিকতা) রক্ষা করা জরুরী নয়। আলবানীও এই মতকে সমর্থন করেছেন।
(৭) রাসূল (স.) কখনও পুরাপুরি মাথা মুছতেন। কখনও আবার শুধু পাগড়ী মুছে মুছার কাজ পূর্ণ করতেন। কিন্তু শুধু কপাল মুছেছেন, এরূপ প্রমাণ নেই।
(৮) রাসূল (স.) মাথা মাসেহ করার সাথে কানের ভিতর ও বাহির মুছতেন। সেজন্য নতুন পানি নিতেন না। এর প্রমাণ হল আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রা.) বর্ণিত হাদীস। ঘাড় মুছার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তিনি কনুই ও পায়ের গীরার উপরেও ধুয়েছেন বলে প্রমাণ নেই।
(৯) রাসূল (স.) পায়ের গোড়ালী ধোয়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। এক সহীহ হাদীসে এসেছে যে, মুহাম্মদ ইবনে যিয়াদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আবু হুরায়রা (রা.) আমাদের কাছ দিয়ে যাচ্ছিলেন। লোকেরা সে সময় পাত্র থেকে ওযু করছিল। তখন তাঁকে বলতে শুনেছি, তোমরা উত্তমরূপে ওযু কর, কারণ আবুল কাসিম (স.) বলেছেন, “পায়ের গোড়ালীগুলোর জন্য জাহান্নামের শাস্তি রয়েছে।” {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৬৬}
(১০) রাসূল (স.) ওযুর পরে অঙ্গ-প্রতঙ্গ মুছতেন না। কোন সহীহ হাদীসেই সেরূপ প্রমাণ নেই। আয়েশা (রা.) ও মুয়ায বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীসে বস্ত্রখন্ড এবং বস্ত্রাংশ দিয়ে তার অঙ্গপ্রতঙ্গ মুছার যে কথা রয়েছে তা সহীহ নয়। কারণ প্রথম হাদীসটিতে সুলাইমান বিন আকরাম নামে এক রাবী গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি নয়, আর দ্বিতীয় হাদীসের এক রাবী, আল আফিকী দুর্বল রাবী। ইমাম তিরমিযী বলেছেন, “ওযুর অঙ্গপ্রতঙ্গ কাপড় দিয়ে মুছার ব্যাপারে রাসূল (স.) থেকে কোন বিশুদ্ধ হাদীস পাওয়া যায় না”।
(১১) রাসূল (স.) ওযু করার পর দাড়ি খেলাল করেছেন। তবে, সব সময় নয়, মাঝে মধ্যে করেছেন। অবশ্য এই ব্যাপারে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে মতভেদ আছে। ইমাম তিরমিযী প্রমুখের মতে দাড়ি খেলাল করার বিষয়টি সহীহ। কিন্তু ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল এবং আবু যুরআ এর মতে কোন সহীহ হাদীস থেকে দাড়ি খেলাল করার কোন প্রমাণ মেলে না।
(১২) রাসূল (স.) ওযুতে আঙ্গুলও খেলাল করেছেন, তবে নিয়মিত নয়। সুনান গ্রন্থাবলীতে মুস্তাওরাদ বিন সাদ্দাদের বর্ণিত হাদীস থেকে এই কথার প্রমাণ পাওয়া যায়। অবশ্য রাসূল (স.)-এর ওযু সম্পর্কে যারা বিশেষজ্ঞ ছিলেন, যেমন উসমান (রা.), আলী (রা.), আবদুল্লাহ ইবনে যায়েদ (রা.), রুবাঈ (রা.) প্রমুখ, তাঁদের থেকে এই বিষয়ে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাই এই বিষয়টিও দাড়ি খেলাল করার মত সুপ্রমাণিত নয়।
(১৩) ওযুর সময় রাসূল (স.) আংটি এদিক সেদিক ঘুরিয়ে নিতেন বলে একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে এই বর্ণনাটি যঈফ। ইমাম দ্বারাকুতনী হাদীসটির সনদে (বর্ণনা সূত্রের) মুয়াম্মার ও তার পিতাকে যঈফ বর্ণনাকারী আখ্যায়িত করেছেন।
(১৪) রাসূল (স.) কখনো কখনো নিজেই ওযু করতেন। কখনও আবার একজন পানি ঢেলে দিতেন এবং তিনি ওযু করতেন। বুখারী ও মুসলিমে মুগীরা ইবনে শু’বা (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, এক সফরে তিনি রাসূল (স.)-কে পানি ঢেলে দিয়ে ওযু করিয়েছেন। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৮২} কিন্তু এটা কোন নিয়মিত ব্যাপার ছিল না।
(১৫) রাসূল (স.) ঘরে ও প্রবাসে সবখানে মোজার ওপরে মাসেহ করেছেন। যদি মোজা পায়ে থাকত তা খোলা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না, বরং মুছে নিতেন। আর যদি পা খোলা থাকত, পা ধুয়ে নিতেন। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/২০৬}
(১৬) রাসূল (স.) ওযু শুরু করার প্রথমেই ‘বিসমিল্লাহ’ ছাড়া অন্য কিছু পড়তেন না। {বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ ইত্যাদি} ওযুর প্রারম্ভে অপবিত্রতা দূর করার ইচ্ছা করি কিংবা সালাত আদায় করার ইচ্ছা করি ইত্যাদি বলে তিনি বা সাহাবাদের কেউ নিয়্যত করতেন বলে সহীহ বা যঈফ কোন হাদীসেই প্রমাণ নেই।
 
(১৭) রাসূল (স.) ওযু শেষ করে নিম্নলিখিত দু’আটি পড়তেন,
“আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু (আল্লাহুম্মাজআলণী মিনাততাওয়াবীনা ওয়াজ আলনী মিনাল মুতাতাহ্‌হিরীন)।”
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই। আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ আল্লাহর দাস এবং রাসূল। ইয়া আল্লাহ! আমাকে তওবাকারী এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করো।” {মুসলিম, তিরমিযী। “আল্লাহুম্মাজ … … ওয়াজ আলনী মিনাল মুতাত্বাহহিরীন” শব্দগুলি ইমাম তিরমিযী এককভাবে বর্ণনা করেছেন।}”
 
(১৮) রাসূল (স.) ওযুর পরে নিম্নরূপ দু’আও পড়তেন,
“সুবহানাকা ওয়া বিহামদিকা আশহাদুআল লাইলাহা ইল্লা আনতা আস্তাগফিরুকা ওয়া আতুবু ইলাইকা।”
“হে আল্লাহ! সমস্ত ত্রুটি ও অক্ষমতা থেকে মুক্ত তুমি। তোমার প্রশংসা স্বীকার করে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তোমার কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থী আর তোমারই দিকে আমি প্রত্যাবর্তন করছি।”
 
ওযু (৪র্থ ভাগ)
ওযুর নিয়ম
বিশুদ্ধ হাদীস অনুসারে ওযুর নিয়ম নিম্নরূপঃ
(১) প্রথমে মিসওয়াক করতে হবে। {বুখারী, ইফা ২য় খন্ড, হা/৮৪৩; মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/৪৮০, ৪৮৪}
(২) তারপর বিসমিল্লাহ বলে শুরু করতে হবে। {আবু দাউদ, ইফা ১ম খন্ড, হা/১০১}
(৩) ডান দিক থেকে শুরু করতে হবে। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৬৮}
(৪) দু’হাতের কব্জি পর্যন্ত তিনবার ভালভাবে ধুতে হবে। প্রথমে ডান হাত, পরে বাম হাত। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৮৬; মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/৪২৯}
(৫) অতঃপর তিনবার পর্যন্ত ডান হাতে পানি নিয়ে কিছু পানি দিয়ে কুলি করা এবং অবশিষ্ট পানি নাকে দিয়ে নাক ঝাড়তে হবে। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৮৬; মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/৪২৯} বাম হাত দিয়ে নাক ঝাড়তে হবে। {দ্বারাকুতনী}
(৬) তারপর ডান হাতে পানি নিয়ে দুই হাত দিয়ে তিনবার পর্যন্ত মুখমন্ডল (চুলের গোড়া থেকে থুতনীর নীচ ও উভয় কানের লতি এবং চোখের কোণ পর্যন্ত) ধুতে হবে। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৬১}
(৭) তারপর তিনবার পর্যন্ত ডান হাতের কনুই পর্যন্ত ধুতে হবে এবং এইভাবে বাম হাতও কনুই পর্যন্ত ধুতে হবে। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৬১; মুসলিম}
(৮) হাত ধুবার পর হাতে লেগে থাকা পানি দিয়ে মাথা মাসেহ করতে হবে, নতুন করে পানি নেবার দরকার নেই। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৯২}। মাসেহ করার জন্য উভয় হাতের আঙ্গুলের অগ্রভাগ একত্রে মিলিয়ে তা কপালের গোড়া থেকে সম্পূর্ণ মাথা হাতের তালু দিয়ে মুছে হাতের তালু ঘাড় পর্যন্ত নিয়ে যেতে হবে। পুনরায় ঐভাবে উভয় হাতকে ফিরিয়ে আনতে হবে যেখান থেকে আরম্ভ করা হয়েছিল সে পর্যন্ত। যদি মাথায় পাগড়ী থাকে তাহলে মাথার অগ্রভাগ এবং পাগড়ীর উপর দিয়ে উল্লেখিতভাবে মাসেহ করতে হবে। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/২০৫; মুসলিম}
দ্রষ্টব্যঃ অনেকে গর্দান মাসেহ করে থাকেন কিন্তু এর স্বপক্ষে হাদীসের কোন দলীল নেই বিধায় এটা করা বর্জণীয়। ইমাম নববী (র.) বলেন, “ওযুতে ঘাড় মাসেহ প্রমাণহীন ও অঙ্গ ধোয়ার দু’আ ভিত্তিহীন। গর্দান মাসেহ করতে হবে এই মর্মে বর্ণিত কথিত হাদীসটি বানোয়াট।”
(৯) তারপর ডান হাতে পানি নিয়ে বাম হাতে দিয়ে ডান হাত দিয়ে ডান কান এবং বাম হাত দিয়ে বাম কান মাসেহ করতে হবে। {তিরমিযী} শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে কানের ভিতরে এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে কানের পিঠ মাসেহ করতে হবে। {নাসাঈ}
(১০) সব শেষে প্রথমে ডান পা ও পরে বাম পায়ে গোড়ালি পর্যন্ত তিনবার (বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল দিয়ে) পায়ের আঙ্গুলগুলো খিলাল করতঃ ভালভাবে ধুয়ে ফেলতে হবে। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৬৬; তিরমিযী}
(১১) তারপর ডান হাতে পানি নিয়ে পায়জামা বা পরনের কাপড়ের উপর শরম গাহের (লজ্জাস্থানের) দিকে পানির ছিটা দিতে হবে। {তিরমিযী}
(১২) তারপর নিম্নলিখিত যে কোন একটি দু’আ পড়তে হবে,
“আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারীকা লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু (আল্লাহুম্মাজআলণী মিনাত তাওয়াবীনা ওয়াল মুতাতাহ্‌হিরীন)।” {মুসলিম, তিরমিযী; তবে দুই বন্ধনীর মধ্যের অংশটুকু তিরমিযী এককভাবে বর্ণনা করেছেন।}
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি এক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মোহাম্মদ (স.) আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল। (হে আল্লাহ, তুমি আমাকে তওবাকারী এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদের অন্তর্ভুক্ত করো)।”
অথবা,
“সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লা আনতা আস্তাগফিরুকা ওয়া আতুবু ইলাইকা।”
“হে আল্লাহ! সমস্ত ত্রুটি ও অক্ষমতা থেকে তুমি মুক্ত। তোমার প্রশংসা স্বীকার করে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তোমার কাছে আমি ক্ষমা প্রার্থী আর তোমারই দিকে আমি প্রত্যাবর্তন করছি।” {নাসাঈ এর আমালুল ইয়াওমি ওয়াল্লাইলাহ, হা/৮১, ৮৩; হাকিম, তাবারানী প্রভৃতি। হাদীস বিশুদ্ধ।}
 
ওযু (৫ম ভাগ)
ওযু ভঙ্গের কারণ সমূহঃ
(১) পেশাব পায়খানার রাস্তা দিয়ে কিছু বের হলে ওযু ভঙ্গ হবে, যেমন পেশাবের রাস্তা দিয়ে পেশাব বা বীর্য এবং পায়খানার রাস্তা দিয়ে শব্দ ছাড়া বা শব্দ করে বায়ু এবং পায়খানা, কৃমি ইত্যাদি বের হওয়া। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৩০}
কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “আওযাআ আহাদুম মিনকুম মিনাল গায়িতি।” ” তোমাদের কেউ যদি মলমূত্র ত্যাগ করে আসে (তাহলে ওযু নষ্ট হবে)” {সূরা আল মায়িদা, আয়াদ ৬}
(২) কেউ সালাতের মধ্যে হেসে ফেললে কেবল সালাতই দোহরাতে হবে (পুনরায় পড়তে হবে), পুনরায় ওযু করতে হবে না। কেউ যদি চুল অথবা নখ কাটে তাহলে ওযু করতে হবে না। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৩০}
(৩) শরীরের কোন স্থান থেকে ফিন্‌কি দিয়ে রক্ত ছুটলে, ফোঁড়া টিপ দিয়ে রক্ত বের করলে বা রক্ত মিশ্রিত থু থু ফেললে পুনরায় ওযু করার প্রয়োজন নেই। তবে কেউ শিঙ্গাঁ লাগালে কেবল তার শিঙ্গাঁ লাগানো স্থানই ধোয়া প্রয়োজন। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১৩০}
(৪) শরীরের কোন স্থান থেকে রক্ত বা পুঁজ বের হয়ে গড়িয়ে পড়লে ওযু নষ্ট হয়ে যায়। তবে গড়িয়ে না পড়লে ওযু নষ্ট হবে না।
(৫) মুখ ভরে বমি (খাবার হোক বা পানি হোক) করলে এবং থুথুর সাথে বেশী পরিমাণ রক্ত এলে ওযু নষ্ট হয়ে যায়।
(৬) কোন মহিলার স্তন থেকে ব্যথার কারণে দুধ ব্যতীত কিছু পানি বের হলে ওযু নষ্ট হয়ে যায়।
(৭) চিৎ হয়ে বা এক পাশে কাৎ হয়ে ঘুমালে ওযু ভেঙ্গে যায়। তবে হেলান দেয়া ব্যতীত বসে বসে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লে ওযু ভঙ্গ হবে না।
হাদীসে (মুসলিম) উল্লেখ আছে, রাসূল (স.) এর সাহাবাগণ এশার সালাতের শেষ সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন। এভাবে অপেক্ষা করতে করতে তন্দ্রাভরে তাদের মাথা ঝুঁকে পড়ত। কিন্তু পুনরায় ওযু না করেই তাঁরা সালাত আদায় করতেন।
(৮) যে সকল কারণে গোসল ফরয হয় তা ঘটলে ওযু নষ্ট হয়ে যায়।
(৯) মস্তিষ্ক বিকৃত হয়ে গেলে, বোধশক্তি হারিয়ে ফেললে, নেশাগ্রস্তের কারণে মাতাল হলে, সচেতনতা দূর হয়ে গেলে বা সংজ্ঞাহীন হলে ওযু নষ্ট হয়ে যায়।
(১০) হাতের তালু দ্বারা বা আঙ্গুল দ্বারা সরাসরি লিঙ্গ স্পর্শ করলে বা ছোঁয়া লাগলে ওযু নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু কোন কাপড় বা ঐ জাতীয় কিছু মাঝখানে থাকলে ওযু নষ্ট হবে না অর্থাৎ কাপড়ের উপর দিয়ে স্পর্শ করলে ওযু নষ্ট হবে না। আহমাদের একটি হাদীসে বর্ণিত, “যে তার লিঙ্গের উপর হাতের ছোঁয়া লাগালো অথচ মাঝখানে কোন পর্দা ছিল না তাহলে তার ওযু করা কর্তব্য।”
(১১) উটের গোশত খেলে ওযু নষ্ট হয়ে যায়।
দ্রষ্টব্যঃ (১) উটের গোশত খেলে ওযু নষ্ট হওয়া সম্পর্কিত মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে নিম্নরূপ বর্ণিত আছে, জাবের ইবনে সামুরা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (স.) কে জিজ্ঞাসা করল, হুযুর! আমরা কি বকরীর গোশত খেলে ওযু করব? রাসূল (স.) উত্তর দিলেন, “যদি তোমার মন চায় করতে পার, আর যদি মন না চায়, নাও করতে পার।” সে আবার জিজ্ঞাসা করল, আমারা কি উটের গোশত খেয়ে ওযু করব? রাসূল (স.) বললেন, “হ্যাঁ, উটের গোশত খেয়ে ওযু করিও।” অতঃপর সে জিজ্ঞাসা করল, আমরা কি ভেড়ার পালের থাকার স্থানে সালাত পড়তে পারি? রাসূল (স.) বললেন, “হ্যাঁ, পার।” পুনরায় সে জিজ্ঞাসা করল, আমরা কি উটের বাথানে সালাত পড়তে পারি? রাসূল (স.) বললেন, “না।” {মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/৬৮৭}
মিশকাত, ২য় খন্ডে উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় লেখা হয়েছে, এই হাদীস অনুসারে ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল উটের গোশত খাবার পর অবশ্যই ওযু করতে বলেন। অপর ইমামগণের কাছে এই হাদীস মনসুখ। সুতরাং তাদের মতে ওযু করার প্রয়োজন নেই। মনসুখ হবার দাবীটি অবশ্য দলীল বিহীন বিধায় তা বাতিল।
(২) সালাতের মধ্যে কোন কিছু হওয়ার (বায়ু নির্গত হওয়ার) ধারণা হলে যতক্ষণ শব্দ না শুনা যায় বা গন্ধ না পাওয়া যায় ততক্ষণ সালাত ছাড়া যাবে না। কেবল সন্দেহ করাতে ওযু যাবে না। মুসলিমে এই সম্পর্কিত একটি হাদীস নিম্নরূপ,
আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন, “যখন তোমাদের কেউ নিজের পেটের মধ্যে কিছু (বায়ু) অনুভব করে এবং সন্দেহ হয় যে, পেট হতে কিছু বের হল কিনা, তখন সে যেন (ওযু নষ্ট হয়ে গিয়েছে ভেবে) মসজিদ হতে বের না হয়, যে পর্যন্ত না সে (বায়ুর) কোন শব্দ শোনে অথবা দুর্গন্ধ পায়।” {মুসলিম, ইফা ২য় খন্ড, হা/৬৯০}
(৩) নাক দিয়ে রক্ত বের হলে এবং সালাতাবস্থায় নাপাকী (অপবিত্র বস্তু) লাগলে ওযু নষ্ট হয় না, অপসারণ বা ধুলেই যথেষ্ট হয়।
 
ওযু (শেষ ভাগ)
ওযুর ফরযঃ
রাসূল (স.) বর্ণনা করেছেন, “ওযুর ফরয হল এক একবার করে ধৌত করা।” {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/ ৯৬ পরিচ্ছেদ} তিনি দু দুবার এবং তিন তিনবার করেও ওযু করেছেন, কিন্তু তিনবারের বেশী ধৌত করেননি। পানির অপচয় করা এবং রাসূল (স.)-এর আমলের সীমা অতিক্রম করাকে ওলামায়ে কিরাম মাকরূহ বলেছেন।
 
নিম্নলিখিত কাজগুলি ওযুর ফরয
(১) নিয়্যত করা অর্থাৎ মনে মনে সংকল্প করা।
(২) মুখমন্ডল একবার ধৌত করা। এর মধ্যে কুলি করা এবং নাকে পানি দিয়ে নাক ঝাড়াও অন্তর্ভুক্ত।
(৩) কনুই সহ দুই হাত ধৌত করা।
(৪) সম্পূর্ণ মাথা মাসেহ করা। এর সঙ্গে দুই কানের ভিতর এবং কানের পিঠ মাসেহ করাও অন্তর্ভুক্ত।
(৫) দুই পায়ের গিরাসহ ধৌত করা।
দ্রষ্টব্যঃ
(১) উক্ত ফরযগুলির যে কোন একটি বাদ পড়লে এবং কোন অঙ্গ চুল পরিমাণ শুকনা থাকলে ওযু হবে না।
(২) অনেকের ধারণা তারতীব (ধারাবাহিকতা) বজায় রাখা ওযুর একটি ফরয। রাসূল (স.) থেকে বিনা ধারাবাহিকতায়ও ওজু করা প্রমাণিত।
ওযু সম্মন্ধে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মাসাইল (নিয়মকানুন)
(১) ওযুর মধ্যে পশম পরিমাণ স্থানও যেন শুকনা না থাকে।
(২) ওযুর যে যে অঙ্গ ধুতে হয় তা এক এক বার, দুই দুই বার বা তিন তিন বার ধোয়া যায় তবে তিন বারের অধিক ধোয়া জায়েজ নয়।
(৩) যদি শরীরের ওযুর স্থানে কোন ব্যান্ডেজ বা পট্টি বাঁধা থাকে কিংবা জখম বা ফোঁড়া বা ফুসকুড়ি থাকে এবং তাতে পানি লাগলে ক্ষতি হবার আশঙ্কা থাকে, তাহলে তা না ধুয়ে ভিজা হাত দিয়ে মাসেহ করলে চলবে।
(৪) পাগড়ীর উপর এবং উভয় মোজার উপর মাসেহ করা যায়। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/১০৫} ওযু করে মোজা পরার পর যদি ওযুর দরকার হয় তাহলে মোজা না খুলে মোজার উপরে মাসেহ করা যেতে পারে {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/২০৬}
(৫) মুকীম (নিজ স্থানে বা বাড়ীতে অবস্থানকারী) ব্যক্তিকে এক রাত ও এক দিন পর মোজা খুলে পা ধুতে হবে। মুসাফির ব্যক্তিকে তিন রাত ও তিন দিনের পর মোজা খুলে পা ধুতে হবে।
(৬) বকরীর গোশত এবং ছাতু খেয়ে ওযু না করে শুধু কুলি করে সালাত আদায় করা যায়। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/২০৭, ২০৮, ২০৯, ২১০} কিন্তু দুধ পান করলে কুলি করতে হবে না। {বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/২১১}
 
(৭)ওযুসহ রাতে ঘুমাবার ফযীলতঃ
রাসূল (স.) বলেছেন, যখন তুমি বিছানায় যাবে তখন সালাতের মত ওযু করে নেবে। তারপর ডান পার্শ্বে শুয়ে বলবে,
“আল্লাহুম্মা আস’আলতু ওয়াজহী ইলাইকা, ওয়া ফাউওয়াযতু আমরী ইলাইকা, ওয়া আলজাতু যাহরী ইলাইকা, রাগাবাতুন ওয়া রাহবাতান ইলাইকা, লা- মালজাআ’ওয়ালা মানজাআ’ মিন্‌কা ইল্লা ইলাইকা, আল্লাহুম্মা আ’মানতু বি কিতাবিকাল্লাযী আন্‌যালতা ওয়াবি নাবি’য়িকাল্লাযী আরসালতা।”
অর্থাৎ
“হে আল্লাহ! আমার জীবন তোমার কাছে সমর্পন করলাম। আমার সকল কাজ তোমার কাছে সোপর্দ করলাম এবং আমি তোমার কাছে আশ্রয় গ্রহণ করলাম- তোমার প্রতি আগ্রহ ও ভয় নিয়ে। তুমি ছাড়া কোনো আশ্রয়স্থল ও নাজাতের স্থান নেই। হে আল্লাহ! আমি ঈমান আনলাম তোমার নাযিলকৃত কিতাবের উপর এবং তোমার প্রেরিত রাসূলের উপর।”
তারপর যদি রাতেই তোমার মৃত্যু হয় তবে ফিতরাতে ইসলামের উপর তোমার মৃত্যু হবে। এ কথাগুলি তোমার শেষ কথা বানিয়ে নাও।”{বুখারী, ইফা ১ম খন্ড, হা/২৪৫}
 
~~~সমাপ্ত~~~
 
“আমার নামায কি শুদ্ধ হচ্ছে!”
গ্রন্থ থেকে মুমিন ভাই-বোনদের উপকারার্থে এখানে প্রকাশিত হলো। 

মন্তব্য করুন

No comments found.

New comment