মাযহাব বলতে কি বুঝায়?

 

লিখেছেনঃ সিদ্দীক //

মাযহাবের সঠিক অর্থ চলার পথ, কিন্তু মাযহাব অনুসারীগণ এর অর্থ করেন মত ও পথ। এই অর্থে দুনিয়ার যত মত ও পথ আছে সবই মাযহাব। ইমাম আবু হানিফার মত ও পথ হানাফী মাযহাব। অনুরূপ ইমাম মালেকের মত ও পথ মালেকী মাযহাব, ইমাম শাফেয়ীর মত ও পথ শাফেয়ী মাযহাব ও ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের মত ও পথ হাম্বলী মাযহাব। তা হলে নবী মুহাম্মাদুর রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর মত ও পথ নিঃসন্দেহে মুহাম্মদী মাযহাব। আর সকলের মত ও পথের চেয়ে মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মত ও পথ যে অতি উত্তম ও উত্কৃষ্ট মত ও পথ এ কথা কোন মুসলমানকে বলে দিতে হবে না। কাজেই অন্যান্য সকলের মত ও পথকে বর্জন করে মহানবীর মহাপবিত্র মত ও পথেই আমাদেরকে চলতে হবে। অন্য কারো মতে ও পথে চলার জন্য নির্দেশ নাই।

যে সকল ইমামদের নামে মাযহাবের নামকরণ হয়েছে তাদের জন্মের আগে মাযহাব ছিল না, তাঁদের যামানায় মাযহাবের উদ্ভব হয় নাই। মাযহাব হয়েছে তাঁদের মৃত্যুর বহুদিন পরে। ইমাম আবু হানিফার জন্ম ৮০ হিজরীতে, মৃত্যু ১৫০ হিজরীতে; ইমাম মালেকের জন্ম ৯০ হিজরীতে, মৃত্যু ১৭৯ হিজরীতে; ইমাম শাফেয়ীর জন্ম ১৫০ হিজরীতে, মৃত্যু ২০৪ হিজরীতে; আর ইমাম আহমাদ বিন হাম্বলের জন্ম ১৬৪ হিজরীতে, মৃত্যু ২৪১ হিজরীতে। যেদিন ইমাম আবু হানিফার মৃত্যু হল সেই দিন ইমাম শাফেয়ীর জন্ম হয়েছে। এই দুই জনের পরস্পরের সঙ্গে কারো দেখা সাক্ষাত হয় নাই। মাযহাবের উদ্ভব হয়েছে ৪০০ হিজরীতে। ইমাম আবু হানিফার মৃত্যুর ২৫০ বত্সর পরে। এই চার ইমামের জন্মের পূর্বেও ইসলাম ছিল, মুসলিম ছিল। তখন যদি কারোর মত ও পথের প্রয়োজন না হয়ে থাকে তাহলে ৪০০ বত্সর পরে প্রয়োজন হবার বা ফরয হবার কোন যুক্তি থাকে না। তখনও মুসলিমদের কাছে কুরআন ও হাদীস ছিল, এখনও আছে, কাজেই কুরআন ও হাদীসই যথেষ্ট। সুতরাং নির্ভুল কুরআন হাদীসই মুসলিমদের মেনে চলতে হবে। চার মাযহাবের কোন একটিও মেনে চলার জন্য আল্লাহ ও রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নির্দেশ নাই।

 

বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ, এখানকার জনগোষ্ঠির প্রায় ৮৬% মুসলমান। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ধর্মভীরু সুন্নী, কিন্তু সঠিক ধর্মীয় শিক্ষাদীক্ষার অভাবে তারা প্রায়শঃই বিভিন্ন ধরণের শিরক, বিদ’আতকে ইসলামী শরিয়াহ-র অংশ হিসাবে গণ্য করে আসছে। এরা মাযহাব সম্বন্ধে খুবই সচেতন, এক মাযহাব অনুসারী অন্য মাযহাবীকে তাচ্ছিল্যভাবে দেখে।

এদের বেশীর ভাগের ধারণা চারজন ইমামের অনুসরণীয় মাযহাব স্বীকার করা ফরজ, শরীয়তের উপর আমল করতে চার ইমামের একজনের পয়রবী করা ওয়াজিব, বিপরীত করলে অর্থাত্ যে কোন একটি মাযহাব না মানলে শরীয়ত হতে খারিজ হতে হবে, এক মাযহাব-এ থেকে অন্য মাযহাবের কোন অংশ অনুসরণ করা যাবে না, চারজনের মধ্যে আজীবন শুধু মাত্র একজনের অন্ধ অনুসরণ করতে হবে ইত্যাদি।

এছাড়াও বিভিন্ন অপসংস্কৃতির সংমিশ্রনে এদেশে যে সব আচার-আচরণ, ধর্মীয় বিশ্বাস গড়ে উঠেছে সেগুলির বেশির ভাগই ভ্রান্ত এবং কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত সঠিক আচার আচরণ নয়। এই কারণেই বর্তমানে আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের আদায়কৃত সালাত এবং রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আদায়কৃত সালাতের তরীকার মধ্যে সচরাচর ভিন্নতা দৃশ্যমান হয়। মাযহাব-এর শাব্দিক অর্থ কি, চার মাযহাব কখন সৃষ্টি হয়েছে, রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তাঁর সাহাবীগণের মাযহাব কি ছিল, চারজন ইমাম কোন মাযহাব মানতেন, চার মাযহাব মানা কি ফরয, মাযহাব ইসলামের কি ক্ষতি করছে ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা থাকলে এ দেশের মুসলমানদের ইসলাম ও মাযহাব সম্বন্ধে একটি স্বচ্ছ হতো এবং কুরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত সঠিক পথে চলা সম্ভবপর হতো।

 

 

চার মাযহাব ফরয হবার কোন দলীল নেই

আমাদের সমাজে প্রচার রয়েছে চার মাযহাবে চার ফরয। কিছু একটি ফরয হলে তা সমস্ত মুসলিম জাতির জন্যই ফরয হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে মাযহাব অনুসরণের কারণে মুসলিম জাতি বিভক্ত হয়ে পড়েছে। অর্থাৎ যিনি হানাফী মাযহাবের অনুসরণ করেন, তিনি হাম্বলী, মালেকী ও শাফেয়ী মাযহাবের অনুসরণ করেন না। এমনিভাবে অন্য মাযহাবীরাও একে অন্যের মাযহাব মানেন না। তাদের কথা হল চার ফরয তথা চার মাযহাবের যে কোন একটি মানলেই হল। তাহলে তো পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের এক ওয়াক্ত মানলে বা পড়লেই হয়। চার মাযহাব ফরয করতে কোন নবীর আগমন ঘটেনি বরং অজ্ঞ জাহেল ব্যক্তিই মাযহাব ফরয দাবী করে মুরতাদ, কাফেরের পরিচয় দিয়েছে। যাদের নামে মাযহাব মানা হচ্ছে তাঁরা কি আদৌ এ মাযহাব তৈরী করেছেন? প্রকৃত ঘটনা হল এই যে,

ইমামগণ প্রচলিত মাযহাব তৈরী করেন নি বা কাউকে তৈরী করতেও বলেননি এবং তাদের উপর চার মাযহাব ফরযও হয়নি। বরং চারশত হিজরীর পর, অতিভক্তির পরিণতির কারণে এই চার মাযহাবের উদ্ভব হয়।

যদি ধরেও নেয়া হয় যে ইমামগণ চার মাযহাব তৈরী করেছেন, কিন্তু তা ফরয হল কি ভাবে? তাঁরাতো নবী ছিলেন না। তাদের নিকট ওহীও আসত না। এগুলি তাঁদের নামে মিথ্যা অপবাদ ব্যতীত আর কিছুই না। তাঁদের সময় এবং তাঁদের পূর্বে একটি মাযহাবই ছিল। তাঁরা ঐ একটি মাযহাবকেই মানতেন এবং অন্যকে মানতে বলতেন। ঐ একটি মাযহাবই ফরয যা নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর অবতীর্ণ করা হয়েছে।

 

হাদীসকে আঁকড়ে ধরার প্রতি ইমামগণের উপদেশ

চার ইমামকে (রহঃ) আমাদের তরফ হতে আল্লাহ উত্তম বদলা দান করুন। তাঁরা প্রত্যেকেই তাদের নিকট যে হাদীস সমূহ পৌঁছেছিল সে অনুযায়ী ইজতেহাদ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে যে মতানৈক্য হয়েছিল তার বিশেষ কারণ হল যে, কারো নিকট কতক হাদীস পৌঁছেছিল যা অন্যের নিকট পৌঁছেনি, কারণ তদানীন্তন যুগে হাদীস সংকলিত হয় নি। আর হাদীসের হাফেযগণ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন, কেউ ছিলেন হিজাযে (মক্কা ও মদীনায়), আর কেউ ছিলেন শ্যামে (সিরিয়ায়), কেউ বা ইরাকে, আবার কেউ মিসরে অথবা অন্যান্য ইসলামী দেশে। সে যুগে এক স্থান হতে অন্য স্থানের যোগাযোগ ছিল অত্যন্ত কঠিন ও কষ্টকর। কাজেই আমরা দেখতে পাই যে, ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) যখন ইরাক ছেড়ে মিসরে গেলেন তখন তিনি ইরাকের পুরাতন মাযহাব ত্যাগ করলেন। কেননা ততক্ষণে তাঁর সামনে বহু নুতন নুতন সহীহ হাদীস উপস্থাপিত হয়েছিল।

ইমামগণের মধ্যে মতানৈক্যের একটি উদাহরণ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইমাম শাফেয়ীর (রহঃ) মতে কোন মহিলাকে স্পর্শ করলে ওযু নষ্ট হয়ে যায়। অপরদিকে ইমাম আবু হানিফার (রহঃ) মতে ওযু নষ্ট হয় না। দুই ইমামের মতামতের এই বৈষম্যতার কারণে আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য হল, কুরআন ও সহীহ হাদীসের দিকে প্রত্যাবর্তন করা। কারণ মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ

“অতঃপর কোনো ব্যাপারে তোমরা যদি একে অপরের সাথে মতবিরোধ করো, তাহলে সে বিষয়টি (ফয়সালার জন্যে) আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও, যদি তোমরা (সত্যিকার অর্থে) আল্লাহর ওপর এবং শেষ বিচার দিনের ওপর ঈমান এনে থাকো! (তাহলে) এই পদ্ধতিই হবে (তোমাদের বিরোধ মিমাংসার) সর্বোত্কৃষ্ট উপায় এবং বিরোধপূর্ণ বিষয়সমূহের ব্যাখ্যার দিক থেকেও (এটি) হচ্ছে উত্তম পন্থা।
{সূরা আন্ নিসা, আয়াত ৫৯}

আর আমরাতো কেবল আল্লাহর নিকট হতে অবতারিত কুরআনের অনুসরণ করার জন্য আদিষ্ট হয়েছি। আর রাসূল (সঃ) সহীহ হাদীসের মাধ্যমে তার ব্যাখ্যা দান করেছেন। তাই এরশাদ হচ্ছেঃ

“(হে মানুষ, এ কিতাবে) তোমাদের মালিকের কাছ থেকে তোমাদের কাছে যা কিছু পাঠানো হয়েছে তোমরা তার (যথাযথ) অনুসরণ করো এবং তা বাদ দিয়ে তোমরা অন্য কোনো অলি আউলিয়ার পৃষ্ঠপোষকদের অনুসরণ করো না; (আসলে) তোমরা খুব কমই উপদেশ মেনে চলো।
{সূরা আল আ’রাফ, আয়াত ৩}

সত্য কোন সময় একাধিক হতে পারে না। প্রকৃত সত্য হল, ওযু ভঙ্গের কারণগুলির মধ্যে কোন মহিলাকে স্পর্শ করা অন্তর্ভুক্ত নয় বিধায় কোন মহিলার শরীর স্পর্শ করলে ওযু ভঙ্গ হবে না।

সুতরাং কোন মুসলিমের সামনে কোন সহীহ হাদীস উপস্থাপিত হলে তাকে একথা বলা জায়েয নয় যে, এটা আমাদের মাযহাব বিরোধী। কারণ সমস্ত ইমামের ইজমা (ঐকমত্য) হচ্ছে যে সহীহ হাদীস গ্রহণ করবে এবং ঐ সমস্ত মতবাদ পরিহার করবে যা সহীহ হাদীসের পরিপন্থী।

 

 

হাদীস সম্পর্কে ইমামগণের অভিমত

নীচে ইমাম (রহঃ) গণের কতিপয় উক্তি তুলে ধরা হচ্ছে। তাদেরকে কেন্দ্র করে যেসব দোষারোপ করা হয় তাঁদের এই উক্তির মাধ্যমেই তা দূরীভূত হবে এবং তাদের অনুসারীদের নিকট ন্যায় ও সত্য স্পষ্ট রূপে উদঘাটিত হবে।

 

প্রত্যেক ব্যক্তিই যার ফিকহের নিকট ঋণী সেই ইমাম আবু হানিফা (রহঃ) বলেনঃ

(১) কোন ব্যক্তির জন্য আমাদের কোন কথাকে গ্রহণ করা হালাল হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সে জ্ঞাত না হবে যে, তা আমরা কোথা থেকে প্রাপ্ত হয়েছি।

(২) আমার দলীল না জেনে, শুধু কথার উপর ভিত্তি করে ফতোয়া দেয়া হারাম। কারণ আমরা মানুষ, আজ এক কথা বলি, আগামীকাল আবার ওটা হতে প্রত্যাবর্তন করি।

(৩) যদি আমি এমন কোন কথা বলি, যা আল্লাহর কিতাব কিংবা রাসূল (সঃ) এর হাদীসের পরিপন্থী হয়, তাহলে আমার কথাকে পরিহার করবে।

(৪) যদি কোন হাদীস সহীহ প্রমাণিত হয় তাহলে ওটা মাযহাবের প্রতিকূলে হলেও ঐ হাদীসেরই উপর আমল করতে হবে, আর সেটাই হবে আমার মাযহাব। কোন মুকাল্লিদ (অন্ধানুসারী) সেই হাদীসের উপর আমলের দরুন হানাফী মাযহাব থেকে বের হয়ে যাবেনা।

(৫) যদি হাদীস সহীহ প্রকট হয়, তবে ওটাই আমার মাযহাব।


ইমাম মালেক (রহঃ) যিনি মদীনাবাসীদের ইমাম বলে সুবিদিত ছিলেন, তিনি বলেনঃ

(১) আমিতো একজন মানুষ মাত্র, ভুলও বলি, সঠিকও বলি। তাই আমার অভিমতকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে তার মধ্যে যেগুলো কুরআন ও হাদীসের অনুকূলে হয় তা গ্রহণ কর, আর যে গুলো কুরআন ও হাদীসের প্রতিকূলে হয়, তাকে পরিহার কর।

(২) রাসূল (সঃ) এর পরে কোন ব্যক্তি নেই যার সব কথা গ্রহণীয়, বর্জনীয় নয় বরং কিছু কথা গ্রহণীয় হতে পারে আবার বর্জনীয় হতে পারে। একমাত্র রাসূলের (সঃ) কথার সবগুলোই গ্রহণীয়, কোন কিছুই অগ্রহণীয় নয়।


ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) যিনি আহলে-বাইতের (নবীর বংশধরের) একজন, তিনি বলেনঃ

(১) এমন কেউ নেই যার নিকট রাসূলের (সঃ) সমস্ত হাদীস পৌঁছেছে বরং কিছু হাদীস পৌঁছেছে আর কিছু তাঁর অজ্ঞাত রয়ে গেছে, তাই আমি যত কথাই বলিনা কেন, আর যতই কায়দা প্রণয়ন করিনা কেন, যদি রাসূল (সঃ) হতে তার প্রতিকূলে কোন কথা থাকে তবে রাসূল (সঃ) এর কথাই গ্রহণযোগ্য আর সেটাই আমার উক্তি বা মত।

(২) মুসলমানদের ইজমা (ঐকমত্য) এই যে, যদি কোন ব্যক্তির নিকট রাসূল (সঃ) এর কোন সুন্নাত স্পষ্টভাবে প্রকট হয় তবে তাঁর কথা ছাড়া অন্য কারো কথা গ্রহণ করা জায়েয হবে না।

(৩) যদি আমার কোন কিতাবে রাসূল (সঃ) এর হাদীসের বিপরীত কোন কথা পাও, তবে রাসূল (সঃ) এর কথাকেই গ্রহণ করবে সেটাই আমার মত।

(৪) যদি কোন হাদীস সহীহ হয় তাহলে সেটাই আমার মাযহাব।

(৫) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রঃ) কে সম্বোধন করে উক্তিঃ তোমরা আমার অপেক্ষা হাদীস ও তার বর্ণনাকারীদের বিষয়ে অধিক জ্ঞাত আছ। অতএব যদি কোন হাদীস সহীহ সূত্রে পাও তাহলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দেবে যেন আমি তা অবলম্বন করতে পারি।

(৬) যে সমস্ত মাসআলা আমি বলেছি তার প্রতিকূলে যদি হাদীস বিশারদদের নিকট সহীহ হাদীস প্রমাণিত হয়, তাহলে আমার বলা মাসআলা থেকে আমি আমার জীবদ্দশাতে ও মৃত্যুর পর প্রত্যাবর্তন করছি।


ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহঃ) যাঁকে আহলে সুন্নাতদের ইমাম বলা হয়, তিনি বলেনঃ

(১) আমার তকলীদ (অন্ধ অনুসরণ) করো না, আর না মালেকের (রহঃ), বা শাফেয়ী (রহঃ) বা আওযায়ী (রহঃ) অথবা সাওয়ারীর (রহঃ) বরং তাঁরা যেখান হতে গ্রহণ করেছেন সেখান হতে গ্রহণ কর (কুরআন ও হাদীস হতে)।

(২) যে ব্যক্তি রাসূল (সঃ) এর কোন হাদীসকে প্রত্যাখ্যান করবে সে তো ধ্বংসের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে।

 

 

কুরআন ও হাদীস অনুসারে মুসলিমদের মাযহাব একটাই

 

মুসলিম জাতির মত বা পথ একটিই। সেটা হল সহজ সরল সোজা পথ। যে পথ সম্পর্কে বলতে যেয়ে একদিন রাসূল (সঃ) একটা সরল রেখা আঁকলেন এবং তার ডান দিকে দুটি এবং বাম দিকে দুটি রেখা আঁকলেন। অতঃপর তিনি তাঁর হাতকে মধ্য রেখায় রেখে বললেনঃ "এটাই আমার পথ। এটাই আমার সোজা পথ, তোমরা এই পথেরই অনুসরণ কর এবং অন্য পথ সমূহের অনুসরণ করো না। যদি কর তবে তা আল্লাহর সোজা পথ হতে তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করে দিবে।"

মুসলিম জাতির মাযহাব একটিই তা হলো ইসলাম / যারা একমাত্র মাযহাব ইসলামকে ভেঙ্গে চৌচির করেছে তারা ধৃষ্টতার পরিচয়ই দিয়েছে। কারণ তাদের আল্লাহর রাসূলের (সঃ) সাথে কোন সম্পর্ক নেই। তাদের দায় দায়িত্ব আল্লাহর নিকট। আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

"যারা নিজেদের দ্বীনকে টুকরো টুকরো করে নিজেরাই নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে গেছে, তাদের কোনো দায়িত্বই তোমার ওপর নেই; তাদের (ফয়সালার) ব্যাপারটা আল্লাহ তায়ালার হাতে, (যেদিন তারা তাঁর কাছে ফিরে যাবে) তখন তিনি তাদের বিস্তারিত বলবেন, তারা কে কি করছিলো।" {সূরা আল আনয়াম, আয়াত ১৫৯}

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেনঃ
"যদি কেউ ইসলাম ছাড়া (নিজের জন্যে) অন্য কোনো জীবন বিধান অনুসন্ধান করে তবে তার কাছ থেকে সে (উদ্ভাবিত) ব্যবস্থা কখনো গ্রহণ করা হবে না, পরকালে সে চরম ব্যর্থ হবে।" {সূরা আল-ই-ইমরান, আয়াত ৮৫}

আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সঃ) মানুষের কল্যাণে ইসলামের বিধি-বিধান (ইসলামী শরীয়ত) জারি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা এই শরীয়তের পূর্ণতার ঘোষণা করে বলেনঃ

"আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীন পূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের ওপর আমার (প্রতিশ্রুত) নেয়ামতও আমি পূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের জন্যে জীবন বিধান হিসাবে আমি ইসলামকেই মনোনীত করলাম" {সূরা আল মায়িদা, আয়াত ৩}

ইন্তেকালের পূর্বে ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে রাসূল (সঃ) তাঁর সাহাবাগণকে তথা সমগ্র জগতকে সম্বোধন করে বলে গিয়েছেন, "আমি তোমাদের নিকট দুটি মহান বস্তু রেখে গেলাম। যতদিন তোমরা ঐ দুটিকে মজবুত করে ধরে থাকবে ততদিন গুমরাহ হবে না আর তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাত।"

 

মুসলিমদের অবশ্য অনুসরণীয় পথ

শরীয়তের বিধি-বিধান অখন্ড। এর কিছু অংশ গ্রহণ এবং কিছু অংশ বর্জন করা নিষেধ। শরীয়তের প্রতিটি হুকুমের উপর ঈমান আনা এবং সামগ্রিকভাবে শরীয়াত পালন করা অবশ্য কর্তব্য। শরীয়তের কোন বিধানের বিরোধিতা বা লংঘন একই সঙ্গে ইহকালীন এবং পরকালীন দুটি মারাত্মক পরিণতির কারণ। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

“যারা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং (আল্লাহর) যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টির অপচেষ্টা করে, তাদের জন্যে নির্দিষ্ট শাস্তি হচ্ছে এই যে, তাদের হত্যা করা হবে কিংবা তাদের শুলবিদ্ধ করা হবে, অথবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত-পা কেটে ফেলা হবে, কিংবা দেশ থেকে তাদের নির্বাসিত করা হবে; এই অপমানজনক শাস্তি তাদের দুনিয়ার জীবনের জন্যে, (তাছাড়া) পরকালে তাদের জন্যে ভয়াবহ আযাব তো রয়েছেই।” {সূরা আল মায়িদা, আয়াত ৩৩}

আল্লাহ তায়ালা কুরআনে আরও উল্লেখ করেছেন,

“(হে নবী,) তুমি বলো, তোমরা যদি আল্লাহ তায়ালাকে ভালোবাসো, তাহলে আমার কথা মেনে চলো, (আমাকে ভালোবাসলে) আল্লাহ তায়ালাও তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তিনি তোমাদের গুনাহখাতা মাফ করে দেবেন; আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়াবান।” {সূরা আল-ই-ইমরান, আয়াত ৩১}

এই পবিত্র আয়াতটি মীমাংসা করে দিয়েছে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভালবাসার দাবী করে, কিন্তু তার আমল ও বিশ্বাস যদি রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশের অনুরূপ না হয় এবং সে তার সুন্নাতের অনুসারী না হয়, তবে সে তার এ দাবীতে মিথ্যাবাদী। সহীহ হাদীসে রয়েছে যে, রাসূল (সঃ) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন এমন কাজ করে যার উপর আমার নির্দেশ নেই, তা অগ্রাহ্য।

আল্লাহর রাসূলের (সঃ) পর চারশত বছর পর্যন্ত রাসূল (সঃ)-এর মাযহাব ছাড়া অন্য কোন মাযহাবের অস্তিত্ব ছিল না। অতএব, তাঁর নির্দেশানুসারে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর সুন্নাতকে মজবুত করে ধরে থাকাই গুমরাহী হতে বাঁচার একমাত্র উপায়।

 

মাযহাবের ভয়াবহতা সম্বন্ধে সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা

এই একবিংশতিতম শতাব্দীর প্রারম্ভে বর্তমান দুনিয়ার প্রায় ১৪০ কোটি মুসলমানই সর্বত্র কমবেশী নিগৃহীত হচ্ছে এ জন্য যে, মুসলমানরা বিভিন্ন মাযহাব, ফিরকাহ ও ঘরানায় বিভক্ত এবং সাধারণ (Common) শত্রুর বদলে পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বেই অধিকতর লিপ্ত। এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে মাযহাব, ফিরকাহ, ঘরানা নির্বিশেষে গোটা মুসলিম উম্মাহর ঐক্য এখনই গড়ে না তুললে সামাজ্যবাদী-ইহুদীবাদী ও উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের সুপরিকল্পিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষা করা কোনক্রমেই সম্ভবপর হবে না।

 

 

কবরে যা প্রশ্ন করা হবে

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেনঃ

"কুল্লু নাফছিন যাইকাতুল মাউত।" অর্থাৎ "জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণকারী।" {সূরা আনকাবুত, ২৯:৫৭}

অনুরূপ সূরা আল-ই-ইমরান {৩:১৮৫} এবং সূরা আল আম্বিয়ায় {২১:৩৫} উল্লেখ করা হয়েছে "জীব মাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।"

স্বাভাবিক নিয়মে আমাদের দুনিয়ার আয়ুষ্কাল যেদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে সেদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। আমাদেরকে কবরে রাখার পরপরই মুনকার-নকীর প্রশ্ন করবে, "বল, তোমার রব কে; তোমার দ্বীন কি" এবং রাসূলের (সঃ) সূরত মোবারক দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করবে, "ইনি কে?" তখন অথবা পরবর্তীতে হাশরেও কিন্তু জিজ্ঞাসা করা হবে না, "তোমার মাযহাব কি; তুমি কেন অমুক ইমামের তরীকা মোতাবেক চলনি" ইত্যাদি। বরং জিজ্ঞাসা করা হবে, "তুমি কেন রাসূলের (সঃ) নির্দেশিত তরীকা (বা মাযহাব) মোতাবেক চল নাই?"

* মুহাম্মদ আবু হেনা সংকলিত 'আমার নামায কি শুদ্ধ হচ্ছে' থেকে উদ্ধৃত।

 

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন

No comments found.

New comment