শবে বরাতঃ সঠিক দৃষ্টিকোণ - পর্ব -২

সংকলন:আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান*** //

**********************************************************************

আলোচ্যসূচিঃ

১৪ - শবে বরাত সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর অবস্থান
১৫ - শবে বরাত সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার দায়িত্ব উলামায়ে কিরামের
১৬ - একটি বিভ্রান্তির নিরসন
১৭ - বিদ‘আত সম্পর্কে কিছু কথা
১৮ - বিদ‘আতের কুফল
১৯ - সন্দেহজনক নফল ‘আমল থেকে দূরে থাকা উত্তম
২০ - সর্বশেষ আহ্বান
২১ - প্রমাণপঞ্জী

**********************************************************************

 

শবে বরাত সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর অবস্থানঃ 
শবে বরাত উদযাপন করা ও না করার ক্ষেত্রে বিশ্বের মুসলিমদেরকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। 
প্রথমতঃ যারা কোনভাবেই শবে বরাত উদযাপন করেন না ও উদযাপন করাকে ইসলাম সম্মত মনে করেন না। 
দ্বিতীয়তঃ যারা সম্মিলিতভাবে শবে বরাত উদযাপন করেন না ঠিকই, কিন্তু এ রাতে ব্যক্তিগতভাবে চুপে চুপে ‘আমল করা ফাযীলাতপূর্ণ মনে করেন, দিবসে সিয়াম পালন করেন ও রাত্রি জাগরণ করেন। 
তৃতীয়তঃ যারা ১৫ শাবানের রাতে মাসজিদে জমায়েত হয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করেন, কবর যিয়ারত করেন, মাসজিদে ওয়াজ-নাসীহাতে শরীক হন, পরের দিন সিয়াম পালন করেন, এই রাতে হায়াত-মউত, রিয্ক-দৌলত সম্পর্কে আল্লাহ সিদ্ধান্ত নেন বলে বিশ্বাস করেন। সারা রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করেন। তবে আতশ-বাযি, মোমবাতি জ্বালানো ও আলোকসজ্জা ইত্যাদিকে নাজায়েয বলে জানেন। 
চতুর্থতঃ যারা ১৫ শাবানের রাতে আতশবাজি, আলোক সজ্জা ও আমোদ ফুর্তি করেন ও সময় সুযোগ মত ইবাদাত-বন্দেগীও করেন। 
এ চার প্রকার লোকদের মধ্যে প্রথম প্রকারের মানুষের সংখ্যাই বেশী। আমি কিন্তু এ কথা বলতে চাচ্ছিনা যে, অধিকাংশ মুসলিম শবে বরাত পালন করেন না বলে তা করা ঠিক নয়। বরং আমি বলতে চাচ্ছি যে, শবে বরাত সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর এ বিভক্তি শবে বরাত উদযাপন বিদ‘আত হওয়ার একটা স্পষ্ট আলামত। এ ক্ষেত্রে আমি বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) এর কিতাব ‘র্শিক ও বিদয়াত’ থেকে একটি উদ্ধৃতি দেয়া যথার্থ মনে করছি। তিনি লিখেছেনঃ  “আল্লাহর দ্বীন ও শরীয়তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হলো বিশ্বব্যাপী সম-আদর্শতা। এই সমাদর্শ ও স্বাদৃশ্যতা যেমন কাল ও সময়ের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় তেমনি স্থানের ক্ষেত্রেও। আল্লাহ হচ্ছেন রাব্বুল মাশরিকাইন ওয়া রাব্বুল মাগরিবাইন; পূর্ব-পশ্চিম সকল কিছুর রব ও মালিক। তিনি স্থান ও কালের সীমা ও বাধার উর্দ্ধে। তাই তাঁর শরীয়াত ও তাঁর দ্বীনে এক অত্যাশ্চর্য সমতা ও সমাদর্শ বিদ্যমান। তাঁর আখিরী শরীয়াত ও আখিরী নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শে এসে যা হয়েছে তাকমীল -পূর্ণতা প্রদীপ্ত সূর্যের মতই সকলের জন্য সমান এবং আকাশ ও মাটির মত সকলের জন্য সম উপযোগীতাপূর্ণ। প্রথম যুগে এর যে রূপ ও আকৃতি ছিল হিজরী পনের শতকেও উহার রূপ ও আকৃতি সেই একই। প্রাচ্যবাসীদের জন্য এটি যেমন ও যতটুকু, ঠিক তেমন ও ততটুকুই প্রতীচ্যের জন্য। যে সমস্ত নীতি ও নির্দেশ, ইবাদাতের যে রূপ ও আকৃতি, আল্লাহর নৈকট্য লাভের যে সমস্ত সুনির্ধারিত পন্থা ও উপায় আরবদের জন্য ছিল ঠিক তদ্রƒপ আছে তা ভারতবাসীর জন্যও। তাই দুনিয়ার যে কোন অংশের একজন মুসলিম অধিবাসী অপর কোন অংশে যদি চলে যায় তাহলে ইসলামী ফরয আদায় এবং ইবাদাত-বন্দেগী করার ক্ষেত্রে তার কোন অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না। তার জন্য কোন স্থানীয় গাইডের প্রয়োজন পড়ে না। তিনি যদি আলিম হন, শরীয়ত সম্পর্কে বিজ্ঞ হন তাহলে কেবল মুক্তাদীই নয় অধিকন্তু যে কোন স্থানে তিনি ইমামও হতে পারেন। 
বিদ‘আতের অবস্থা এর বিপরীত। এতে সমদৃশ্যতা ও একত্বতা নেই। স্থান ও কালের প্রভাব এতে পরিস্ফুট থাকে। গোটা মুসলিম বিশ্বে এর একটিমাত্র রূপে প্রচলনও হয়ে ওঠে না।” 
সকল ধরনের বিদ‘আতের ক্ষেত্রে উপরোক্ত কথা প্রযোজ্য। শবে বরাত এমনি একটা বিষয় যা আমরা ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা মহা ধুমধামে উদযাপন করছি, কিন্তু অন্য এলাকার মুসলিমদের কাছে এ সম্পর্কে কোন খবর নেই। কি আশ্চর্য! এমন এক মহা-নিয়ামাত যা মক্কা-মদীনার লোকেরা পেলনা, অন্যান্য আরবরা পেলনা, আফ্রিকানরা পেলনা, ইন্দোনেশীয়, মালয়েশীয়রা পেলনা, ইউরোপ-আমেরিকা-অষ্ট্রেলিয়া মহাদেশের লোকেরা পেলনা; অথচ ভাগ্যক্রমে সৌভাগ্যের মহান রাত পেয়ে গেলাম আমরা উপ-মহাদেশের কিছু লোকেরা ও শিয়া মতাবলম্বীরা! 
এ বিষয়টি যদি বিভ্রান্তিকর না হত তাহলে সকল মুসলিমের পাওয়ার কথা ছিল। হাদীসে এসেছেঃ
عن عبد الله بن عمر رضي الله عنهما أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال: إن الله تعالى لا يجمع أمتي على ضلالة. (رواه الترمذي وصححه الألباني في صحيح الجامع رقم ১৮৪৮) 
অর্থঃ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন ঃআল্লাহ তাআলা আমার উম্মতকে কোন গোমরাহী বা বিভ্রান্তিতে একমত হতে দিবেন না। (তিরমিযী) 
অন্য বর্ণনায় এসেছেঃ 
عن أنس رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: إن الله تعالى قد أجار أمتي أن تجمع على ضلالة. (صحيح الجامع ১৭৪৬ رقم ১৭৪৬) 
অর্থঃ সাহাবী আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা আমার উম্মতকে কোন ভ্রান্ত বিষয়ে একমত হওয়া থেকে মুক্তি দিয়েছেন। (সহীহ জামেয়) 
এ হাদীসের অর্থ হল আমার উম্মত যদি কোন বিষয়ে একমত হয় তাহলে সে বিষয়টি বিভ্রান্তিকর হতে পারে না। আর আমার উম্মতের কোন বিষয়ে একমত না হওয়ার বিষয়টি বিভ্রান্ত হওয়ার একটা আলামত হতে পারে। 
শবে বরাত এমনি একটি ‘আমল যে উম্মতে মুসলিমাহ এ বিষয়ে কখনো একমত হয়নি, হওয়া সম্ভবও নয়। আবার যারা উদযাপন করেন তাদের মধ্যেও দেখা যায় ‘আমল ও বিশ্বাসের বিভিন্নতা। 

শবে বরাত সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করার দায়িত্ব উলামায়ে কিরামেরঃ 
ইসলাম ধর্মে যতগুলো বিদ‘আত চালু হয়েছে তা কিন্তু সাধারণ মানুষ বা কাফির মুশরিকদের মাধ্যমে প্রসার ঘটেনি। উহার প্রসারের জন্য দায়ী যেমন এক শ্রেণীর উলামা, তেমনি উলামায়ে কিরামই যুগে যুগে বিদ‘আতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, জেল-যুল্ম বরদাশত করেছেন। 
তাই বিদ‘আত যে নামেই প্রতিষ্ঠা লাভ করুক না কেন উহার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করতে হবে আলেমদেরকেই। তারা যদি এটা না করে কারো অন্ধ অনুসরণ বা অনুকরণ করেন, বিভ্রান্তি ছড়ান বা কোন বিদ‘আতী কাজ-কর্ম প্রসারে ভূমিকা রাখেন, তাহলে এ জন্য তাদেরকে আল্লাহর সম্মুখে জবাবদিহি করতে হবে। যে দিন বলা হবেঃ
وَيَوْمَ يُنَادِيهِمْ فَيَقُولُ مَاذَا أَجَبْتُمُ الْمُرْسَلِينَ.(القصص :৬৫) 
অর্থঃ  আর সে দিন আল্লাহ তাদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করবেন, তোমরা রাসূলদের আহ্বানে কিভাবে সাড়া দিয়েছিলে? (সূরা কাসাস, ৬৫) 
সেদিন তো এ প্রশ্ন করা হবে না যে, তোমরা অমুক পীরের মত অনুযায়ী বা অমুক ইমামের মত অনুযায়ী ‘আমল করেছিলে কিনা। যারা সহীহ সুন্নাহ মত ‘আমল করবে তারাই সেদিন সফলকাম হবে। 

একটি বিভ্রান্তির নিরসনঃ 
১৫ শাবানে দিনের সিয়াম ও রাতের ইবাদাত-বন্দেগী, কুরআন তেলাওয়াত, নফল সালাত, কান্নাকাটি, দু‘আ-মুনাজাত, কবর যিয়ারাত, দান-সাদকাহ, ওয়াজ-নাসীহাত প্রভৃতি নেক ‘আমল গুরুত্বসহকারে পালন করাকে যখন কুরআন ও হাদীস সম্মত নয় বলে আলোচনা করা হয় তখন সাধারণ ধর্ম-প্রাণ ভাই-বোনদের পক্ষ থেকে একটি প্রশ্ন আসে যে, জনাব! আপনি শবে বরাতে উল্লিখিত ইবাদাত-বন্দেগীকে বিদ‘আত বা কুরআন ও সুন্নাহ সম্মত নয় বলেছেন, কিন্তু রোযা রাখা সওয়াবের কাজ ও রুটি তৈরী করে গরীব দুঃখীকে দান করা ভাল কাজ নয় কি? আমরা কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে কিছু চাইলে দোষের কি? 
সুপ্রিয় পাঠকবৃন্দ! নিঃসন্দেহে আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দ‘ুআ-মুনাজাত, সালাত, সিয়াম, দান-ছাদাকাহ, কুরআন তিলাওয়াত, রাত্রি জাগরণ হল নেক ‘আমল। এতে কারও দ্বি-মত নেই। আমরা কখনো এগুলিকে বিদ‘আত বলি না। যা বিদ‘আত বলি এবং যে সম্পর্কে উম্মাহকে সতর্ক করতে চাই তা হল এ রাতকে শবে বরাত বা সৌভাগ্য রজনী অথবা মুক্তি রজনী মনে করে বিভিন্ন প্রকার ‘আমল ও ইবাদাত বন্দেগীর মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করা। এটা কুরআন ও সুন্নাহ পরিপন্থী। এটাই ধর্মে বাড়াবাড়ি। যা ধর্মে নেই তা উদযাপন করা ও প্রচলন করার নাম বিদ‘আত। 
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নবুওয়াতের তেইশ বছরের জীবনে কখনো তার সাহাবীগণকে সাথে নিয়ে মক্কায় মাসজিদুল হারামে অথবা মদীনায় মাসজিদে নবুবীতে কিংবা অন্য কোন মাসজিদে একত্র হয়ে উল্লিখিত ইবাদাত-বন্দেগীসমূহ করেছেন এমন কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাঁর ইন্তেকালের পরে তাঁর সাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) তথা খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে কেহ জানতো না শবে বরাত কি এবং এতে কি করতে হয়। তারা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের ‘আমল প্রত্যক্ষ করেছেন। আমাদের চেয়ে উত্তম রূপে কুরআন অধ্যয়ন করেছেন। তারা তাতে শবে বরাত সম্পর্কে কোন দিক-নির্দেশনা পেলেন না। তারা তাদের জীবন কাটালেন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে, অথচ জীবনের একটি বারও তাঁর কাছ থেকে শবে বরাত বা মুক্তির রজনীর ছবক পেলেন না? যা পালন করতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলে যাননি, যা কুরআনে নেই, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের তা’লীমে নেই, সাহাবীগণের ‘আমলে নেই, তাদের সোনালী যুগের বহু বছর পরে প্রচলন করা শবে বরাতকে আমরা বিদ‘আত বলতে চাই। আমরা বলতে চাই, এটা একটা মনগড়া পর্ব। আমরা মানুষকে বুঝাতে চাই, এই সব প্রচলিত ও বানোয়াট মুক্তির রজনী উদযাপন থেকে দূরে থাকতে হবে। আমরা উম্মতকে কুরআন ও সুন্নাহমুখী করতে এবং সেই অনুযায়ী ‘আমল করাতে অভ্যস্ত করতে চাই। 

বিদ‘আত সম্পর্কে কিছু কথাঃ
বিদ‘আত কাকে বলে এ বিষয়ে অনেকেরই স্পষ্ট ধারণা নেই। অনেকের ধারণা যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে ছিলনা তা-ই বিদ‘আত। আবার অনেকে মনে করেন বর্তমান নিয়মতান্ত্রিক মাদ্রাসা শিক্ষা পদ্ধতি একটি বিদ‘আত, তাবলীগ জামাতের পদ্ধতি বিদ‘আত, বিমানে হজ্জে যাওয়া বিদ‘আত, মাইকে আজান দেয়া বিদ‘আত ইত্যাদি। এ সকল দিক বিবেচনা করে তারা বিদ‘আতকে নিজেদের খেয়াল খুশি মত দুই ভাগ করে কোনটাকে হাসানাহ (ভাল বিদ‘আত) আবার কোনটাকে সাইয়্যেআহ (মন্দ বিদ‘আত) বলে চালিয়ে দেন। আসলে বিদ‘আত সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে এ বিভ্রান্তি। 
বিদ‘আতের আভিধানিক অর্থ হলঃ 
الشيء المخترع على غير مثال سابق ومنه قوله تعالى (قل ما كنت بدعا من الرسل) وجاء على هذا المعنى قول عمر رضي الله عنه (نعمت البدعة
অর্থঃ পূর্বের দৃষ্টান্ত ব্যতীত নতুন সৃষ্ট কোন বিষয় বা বস্তু। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ “বলুন, আমি তো কোন নতুন রাসূল নই। 
আসলে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাসূল হিসাবে নতুনই। কিন্তু এ আয়াতে বিদ‘আত শব্দের অর্থ হল এমন নতুন যার দৃষ্টান্ত ইতোপূর্বে গত হয়নি। আর উমার (রাঃ) তারাবীহর জামাত কায়েম করে বলেছিলেন “এটা উত্তম বিদ‘আত।” এখানেও বিদ‘আতের আভিধানিক অর্থ প্রযোজ্য। 

ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় বিদ‘আতের সংজ্ঞাঃ
ما أحدث في دين الله وليس له أصل عام ولا خاص يدل عليه. ‘যা কিছু আল্লাহর দ্বীনে নতুন সৃষ্টি করা হয় অথচ এর সমর্থনে কোন ব্যাপক বা বিশেষ দলীল প্রমাণ নেই।’ 
অর্থাৎ নব সৃষ্ট বিষয়টি অবশ্যই ধর্মীয় ব্যাপারে হতে হবে। যদি ধর্মীয় ব্যাপার ব্যতীত অন্য কোন বিষয়ে নব-আবিস্কৃত কিছু দেখা যায় তা শরীয়তের পরিভাষায় বিদ‘আত বলে গণ্য হবে না, যদিও শাব্দিক অর্থে তা বিদ‘আত। 
এ প্রসঙ্গে আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) তার ‘র্শিক ও বিদ‘আত’ কিতাবে বিদ‘আতের পরিচ্ছন্ন সংজ্ঞা উল্লেখ করেছেন। তা হলঃ যে বিশ্বাস বা কাজ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করেননি কিংবা পালন করার নির্দেশ দেননি সেই ধরনের বিশ্বাস বা কাজকে দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত করা, এর অঙ্গ বলে সাব্যস্ত করা, সওয়াব বা আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় মনে করে এই ধরনের কাজ করার নাম বিদ‘আত। 
যে সকল বিশ্বাস ও কাজকে দ্বীনের অংশ মনে করে অথবা সওয়াব হবে ধারণা করে ‘আমল করা হয় তা বিদ‘আত। কারণ হাদীসে এসেছেঃ 
عن عائشة رضي الله عنها قالت قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد. (أخرجه البخاري ومسلم
অর্থঃ আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে আমাদের এ ধর্মে এমন কোন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করবে যা ধর্মে অন্তর্ভুক্ত ছিল না তা প্রত্যাখ্যাত হবে। (বুখারী ও মুসলিম) 
এ হাদীস দ্বারা স্পষ্ট হল যে, নতুন আবিস্কৃত বিষয়টি যদি ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরে নেয়া হয় তাহলে তা বিদ‘আত ও প্রত্যাখ্যাত। 
হাদীসে আরো এসেছেঃ 
من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد. (رواه مسلم
অর্থঃ যে ব্যক্তি এমন কাজ করল যার প্রতি আমাদের (ইসলামের) নির্দেশ নেই তা প্রত্যাখ্যাত। (মুসলিম) 
এ হাদীসে “যার প্রতি আমাদের নির্দেশ নেই” বাক্যটি দ্বারা এ কথা বুঝানো হয়েছে যে, বিষয়টি ধর্মীয় হতে হবে। ধর্মীয় বিষয় হিসাবে কোন নতুন ‘আমল করলেই বিদ‘আত হবে। যারা মাইকে আজান দেন তারা জানেন যে, মাইকে আজান দেয়ার আলাদা কোন মর্যাদা নেই বা আজানে মাইক ব্যবহার করা সওয়াবের কাজ বলে তারা মনে করেন না। এমনিভাবে বিমানে হজ্জে যাওয়া, প্রাতিষ্ঠানিক মাদ্রাসার প্রচলন, নাহু সরফের শিক্ষা গ্রহণ প্রভৃতি বিষয় ধর্মীয় বিষয় বলে মনে করা হয় না, তাই তা বিদ‘আত হওয়ার প্রশ্ন আসে না। এ ধরনের বিষয়গুলি বিদ‘আত নয় বরং সুন্নাতে হাসানাহ বলা যেতে পারে। 
অনেকে এ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বিদ‘আতকে দু’ভাগে ভাগ করার চেষ্টা করেন। বিদ‘আতে হাসানাহ ও বিদ‘আতে সাইয়্যেআহ। সত্যি কথা হল বিদ‘আতকে এভাবে ভাগ করাটা হল আরেকটি বিদ‘আত এবং তা হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরিপন্থী। 
কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ 
إياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة. (رواه أبو داود والترمذي وابن ماجه والبيهقي في السنن عن العرباض بن سارية.) 
অর্থঃ সকল নব-আবিস্কৃত (দীনের মধ্যে) বিষয় হতে সাবধান! কেননা প্রত্যেকটি নব-আবিস্কৃত বিষয় বিদ‘আত, আর প্রত্যেকটি বিদ‘আত হল পথভ্রষ্টতা। (আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী) 
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন সকল প্রকার বিদ‘আত ভ্রষ্টতা। এখন যদি বলা হয় কোন কোন বিদ‘আত আছে যা হাসানাহ বা উত্তম, তাহলে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ হাদীসবিরোধী হয়ে যায়। তাই তো ইমাম মালিক (রঃ) বলেছেনঃ 
من ابتدع فى الإسلام بدعة يراها حسنة فقد زعم أن محمدا صلى الله عليه وسلم خان الرسالة، فإن الله سبحانه وتعالى يقول (اليوم أكملت لكم دينكم) فما لم يكن يومئذ دينا فلا يكون اليوم دينا
অর্থঃ যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোন বিদ‘আতের প্রচলন করে আর ইহাকে হাসানাহ বা ভাল বলে মনে করে, সে যেন প্রকারান্তরে এ বিশ্বাস পোষণ করে যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর পয়গাম পৌছাতে খিয়ানাত করেছেন। কারণ আল্লাহ তা‘আলা নিজেই বলেনঃ ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পূর্ণ করে দিলাম।’ সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের যুগে যা ধর্ম রূপে গণ্য ছিল না আজও তা ধর্ম বলে গণ্য হতে পারে না। 
তাই বিদ‘আতে হাসানাহ বলে কোন কিছু নেই। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন আমরা তাই বলব; সকল প্রকার বিদ‘আত গোমরাহী ও ভ্রষ্টতা।
বিদ‘আতে হাসানায় বিশ্বাসীরা যা কিছু বিদ‘আতে হাসানাহ হিসাবে দেখাতে চান সেগুলো হয়ত শাব্দিক অর্থে বিদ‘আত, শরয়ী অর্থে নয় অথবা সেগুলো সুন্নাতে হাসানাহ। যে সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ 
من سن فى الإسلام سنة حسنة فله أجرها وأجر من عمل بها بعده من غير أن ينقص من أجورهم شيء، ومن سن في الإسلام سنة سيئة فله وزرها ووزر من عمل بها من بعده من غير أن ينقص من أوزارهم شيء. (رواه مسلم عن جرير بن عبد الله رضي الله عنهما
অর্থঃ যে ইসলামে কোন ভাল পদ্ধতি প্রচলন করল সে উহার সওয়াব পাবে এবং সেই পদ্ধতি অনুযায়ী যারা কাজ করবে তাদের সওয়াবও সে পাবে, তাতে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন খারাপ পদ্ধতি প্রবর্তন করবে সে উহার পাপ বহন করবে, এবং যারা সেই পদ্ধতি অনুসরণ করবে তাদের পাপও সে বহন করবে, তাতে তাদের পাপের কোন কমতি হবে না। (মুসলিম) 
এখানে একটা প্রশ্ন হতে পারে যে, শবে বরাত উদযাপন, মীলাদ মাহফিল, মীলাদুন্নবী প্রভৃতি আচার-অনুষ্ঠানকে কি সুন্নাতে হাসানাহ হিসাবে গণ্য করা যায় না? মাইকে আজান দেয়া, মাদ্রাসার পদ্ধতি প্রচলন, আরবী ব্যাকরণ শিক্ষা ইত্যাদি কাজগুলো যদি সুন্নাতে হাসানাহ হিসাবে ধরা হয় তাহলে শবে বরাত, মীলাদ ইত্যাদিকে কেন সুন্নতে হাসানাহ হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না? 
পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, বিদ‘আত হবে ধর্মীয় ক্ষেত্রে। যদি নতুন কাজটি ধর্মের অংশ মনে করে অথবা সওয়াব লাভের আশায় করা হয়, তাহলে তা বিদ‘আত হওয়ার প্রশ্ন আসে। আর যদি কাজটি ধর্মীয় হিসাবে নয় বরং একটা পদ্ধতি হিসাবে করা হয় তাহলে তা বিদ‘আত হওয়ার প্রশ্ন আসে না। যেমন ধরুন মাইকে আজান দেয়া। কেহ মনে করেনা যে, মাইকে আজান দিলে সওয়াব বেশী হয় অথবা মাইক ছাড়া আজান দিলে সওয়াব হবে না। তাই সালাত ও আজানের ক্ষেত্রে মাইক ব্যবহারকে বিদ‘আত বলা যায় না। 
তাই বলতে হয় বিদ‘আত ও সুন্নাতে হাসানার মধ্যে পার্থক্য এখানেই যে, কোন কোন নতুন কাজ ধর্মীয় ও সওয়াব লাভের নিয়াত হিসাবে করা হয় আবার কোন কোন নতুন কাজ দ্বীনি কাজ ও সওয়াবের নিয়াতে করা হয় না বরং সংশ্লিষ্ট কাজটি সহজে সম্পাদন করার জন্য একটা নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। 
যেমন আমরা যদি ইতিপূর্বে উল্লিখিত হাদীসটির প্রেক্ষাপটের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, একবার মুদার গোত্রের কতিপয় অনাহারী ও অভাবগ্রস্থ লোক আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এলো। তিনি সালাত আদায়ের পর তাদের জন্য উপস্থিত লোকজনের কাছে সাহায্য চাইলেন। সকলে এতে ব্যাপকভাবে সাড়া দিলেন। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামের আগ্রহ ও খাদ্য সামগ্রী দান করার পদ্ধতি দেখে উল্লিখিত কথাগুলি বললেন। 
অভাবগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য যে পদ্ধতি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে ওটাকে সুন্নাতে হাসানাহ বলা হয়েছে। 
বলা যেতে পারে, সকল পদ্ধতি যদি হাসানাহ হয় তাহলে সুন্নাতে সাইয়্যেআহ বলতে কি বুঝাবে? 
উত্তরে বলব, মনে করুন কোন দেশের শাসক বা জনগণ প্রচলন করে দিল যে এখন থেকে স্থানীয় ভাষায় আজান দেয়া হবে, আরবী ভাষায় দেয়া চলবে না। এ অনুযায়ী ‘আমল করা শুরু হল। এটাকে আপনি কি বলবেন? বিদ‘আত বলতে পারবেন না, কারণ যারা এ কাজটা করল তারা সকলে জানে অনারবী ভাষায় আজান দেয়া ধর্মের নির্দেশ নয় এবং এতে সওয়াবও নেই। তাই আপনি এ কাজটাকে সুন্নাতে সাইয়্যেআহ হিসাবে অভিহিত করবেন। এর প্রচলনকারী পাপের শাস্তি প্রাপ্ত হবে, আর যারা ‘আমল করবে তারাও। 
আবার অনেক উলামায়ে কিরাম বিদ‘আতকে অন্যভাবে দু ভাগে ভাগ করে থাকেন। তারা বলেন বিদ‘আত দু প্রকার। একটা হল বিদ‘আত ফিদ্দীন (البدعة في الدين) বা ধর্মের ভিতর বিদ‘আত। অন্যটা হল বিদ‘আত লিদ্দীন (البدعة للدين) অর্থাৎ ধর্মের জন্য বিদ‘আত। প্রথমটি প্রত্যাখ্যাত আর অন্যটি গ্রহণযোগ্য। 
আমার মতে এ ধরণের ভাগ নি¯প্রয়োজন, বরং বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে সহায়ক। কারণ প্রথমতঃ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন সকল বিদ‘আত পথভ্রষ্টতা বা গোমরাহী। এতে উভয় প্রকার বিদ‘আত শামিল। 
দ্বিতীয়তঃ অনেকে বিদ‘আত ফিদ্দীন করে বলবেন, আমি যা করেছি তা হল বিদ‘আত লিদ্দীন। যেমন কেহ মীলাদ পড়লেন। অতঃপর যারা এর প্রতিবাদ করলেন তাদের সাথে তর্কে লিপ্ত হয়ে অনেক দূর যেয়ে বললেন, মীলাদ পড়া হল বিদ‘আত লিদ্দীন। এর দ্বারা মানুষকে ইসলামের পথে ডাকা যায়। 
আসলে যা বিদ‘আত লিদ্দীন বা দ্বীনের স্বার্থে বিদ‘আত তা শরীয়তের পরিভাষায় বিদ‘আতের মধ্যে গণ্য করা যায় না। সেগুলোকে সুন্নাতে হাসানাহ হিসাবে গণ্য করাটাই হাদীসে রাসূল দ্বারা সমর্থিত। 
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! বিদ‘আত সম্পর্কে এ কথাগুলো এখানে এ জন্য আলোচনা করলাম যাতে আলোচ্য বিষয়ের উপর কোন প্রশ্ন বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হলে তার সমাধান যেন পাঠকবৃন্দ সহজে অনুধাবন করতে পারেন। 

বিদ‘আতের কুফলঃ
এমন অনেকের সাক্ষাত পাবেন যারা ইসলামী চেতনায় সমৃদ্ধ। কিন্তু বলেন, বিদ‘আতের বিরোধিতায় এত বাড়াবাড়ির কি দরকার? কেহ একটু মীলাদ পড়লে, কুলখানি বা চল্লিশা-চেহলাম পালন কিংবা এ জাতীয় কিছু করলে দ্বীন ইসলামের কি এমন ক্ষতি হয়ে যায়? 
আমি একদিন এক মাসজিদের ইমাম সাহেবের বক্তব্য শুনছিলাম। তিনি বলছিলেন শবে মিরাজ উপলক্ষ্যে এ রাতে কোন বিশেষ সালাত, ইবাদাত-বন্দেগী বা সিয়াম নেই। যদি শবে মিরাজ উপলক্ষ্যে কোন ‘আমল করা হয় তা বিদ‘আত হিসাবেই গণ্য হবে। 
তার এ বক্তব্য শেষ হতে না হতেই কয়েকজন শিক্ষিত শ্রেণীর মুসল্লী বলে উঠলেন, হুজুর এ কি বলেন! রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বতে এ রাতে কিছু করলে বিদ‘আত হবে কেন? প্রশ্নকারী লোকগুলো যে বিভ্রান্ত বা বিদ‘আতপন্থী তা কিন্তু নয়। তাদের খারাপ কোন উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু তারা যা করার ইচ্ছা করেছেন, উহার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। 
অবশ্যই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহব্বত ঈমানের অঙ্গ। আর সব ধরনের মুহাব্বতেই আবেগ থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহব্বতেও থাকবে। কিন্তু সেই আবেগ যেন মুহব্বতের নীতিমালা লংঘন না করে। সেই আবেগভরা মুহাব্বত যেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ও সুন্নাহর বিরুদ্ধে ব্যবহৃত না হয়। যদি এমনটি হয় তাহলে বুঝতে হবে যে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বতের নামে শয়তান তাকে ধোকায় ফেলেছে। 
এ কথাতো মুসলিমদের কাছে দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, খৃষ্টানরা বিদ‘আতী কাজ-কর্ম করে ও তাদের নবীর মুহব্বতে বাড়াবাড়ি করে পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। এ কথা যেমন আল-কুরআনে এসেছে, তেমনি হাদীসেও আলোচনা করা হয়েছে। আমি অতি সংক্ষেপে এখানে বিদ‘আতের কতিপয় পরিণাম সম্পর্কে আলোচনা করছি যার অধিকাংশ شرح رياض الصالحين من كلام سيد المرسلين، للشيخ محمد بن صالح العثيمين- رحمه الله নামক কিতাব থেকে নেয়া হয়েছে। 
(১) বিদআত মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। 
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা উম্মতের জন্য নিয়ে এসেছেন তা হল হক্ক। এ ছাড়া যা কিছু ধর্মীয় আচার হিসাবে পালিত হবে তা পথভ্রষ্টতা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ 
فماذَا بَعْدَ الْحَقِّ إِلَّا الضَّلَالُ (يونس : ৩২)  অর্থঃ হক আসার পর বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কি থাকে? (সূরা ইউনূস, ৩২) 
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ كل بدعة ضلالة
অর্থঃ সকল ধরনের বিদ‘আত পথভ্রষ্টতা। (মুসলিম, ইবনে মাজাহ) 
(২) বিদ‘আত রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের আনুগত্য থেকে মানুষকে বের করে দেয় এবং সুন্নাতের বিলুপ্তি ঘটায়। 
কেননা বিদ‘আত অনুযায়ী কেউ ‘আমল করলে অবশ্যই সে এক বা একাধিক সুন্নাত পরিত্যাগ করে। উলামায়ে কিরাম বলেছেনঃ “যখন কোন দল সমাজে একটা বিদ‘আতের প্রচলন করে, তখন সমাজ থেকে কম করে হলেও একটি সুন্নাত বিলুপ্ত হয়ে যায়।” 
আর এটা অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত যে, যখনই কোন বিদ‘আত ‘আমলে আনা হয়েছে তখনই সেই স্থান থেকে একটি সুন্নাত চলে গেছে বা গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে মুজাদ্দিদ আলফেসানীর মাকতুবাত থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যায়। তিনি লিখেছেনঃ এক ব্যক্তি আমাকে প্রশ্ন করল ‘আপনারা বলেছেনঃ যে কোন বিদ‘আত নাকি একটি সুন্নাতকে বিলুপ্ত করে। আচ্ছা, যদি মৃত ব্যক্তিকে কাফনের সাথে একটি পাগড়ী পড়িয়ে দেয়া হয় তাহলে কোন সুন্নাতটি বিলুপ্ত হয়? কি কারণে এটা বিদ‘আত বলা হবে?’ আমি জবাবে লিখলামঃ অবশ্যই একটি সুন্নাত বিলুপ্ত হয় যদি মৃতের কাফনে পাগড়ী দেয়া হয়। কারণ পুরুষের কাফনের সুন্নাত হল কাপড়ের সংখ্যা হবে তিন। পাগড়ী পড়ালে এ সংখ্যা আর ‘তিন’ থাকেনা, সংখ্যা দাড়ায় ‘চার।’ 
উদাহরণ হিসাবে আরো বলা যায়, এক ব্যক্তি ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ল। ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এ সমস্যার জন্য এক পীর সাহেবের কাছে গেল। পীর সাহেব তাকে বললেন, তুমি এক খতম কুরআন বখশে দাও অথবা নির্দেশ দিলেন একটা মীলাদ দাও বা খতমে ইউনূসের ব্যবস্থা কর। সে তাই করল। ফলাফল কি দাড়াল? ঋণ পরিশোধে অক্ষম ব্যক্তির জন্য একটি দু‘আ রয়েছে যা ‘আমল করা সুন্নাত। বিদ‘আত অনুযায়ী ‘আমল করার কারণে সে সেই সুন্নাতটি পরিত্যাগ করল। জানার চেষ্টা করলনা যে, এ ক্ষেত্রে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি ব্যবস্থা দিয়ে গেছেন। অন্যদিকে সে মিলাদ, কুরআন খতম ইত্যাদি বিদ‘আতী কাজ করে আরও আর্থিক ঋণভারে জর্জরিত হলো। 
রামাযানের শেষ দশ দিনের রাতসমূহে রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত, যা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। কিন্তু ১৫ শাবানে রাত জাগাকে যেমন গুরুত্ব দেয়া হয় তেমনভাবে এ সুন্নাতী ‘আমলের প্রচলন দেখা যায় না। বরং শবে কদরের মূল্যায়ন শবে বরাতকে করা হচ্ছে। 
ফরয সালাত আদায়ের পর সর্বদা জামাতবদ্ধ হয়ে মুনাজাত করা একটি বিদ‘আত। এটা ‘আমল করার কারণে ফরয সালাত আদায়ের পর যে সকল যিক্র-আযকার সুন্নাত হিসাবে বর্ণিত আছে তা পরিত্যাগ করা হয়। 
আপনি দেখবেন এভাবে প্রতিটি বিদ‘আত একটি সুন্নাতকে অপসারিত করে উহার স্থান দখল করে নিয়েছে। 
(৩) বিদ‘আত আল্লাহর দ্বীনকে বিকৃত করে। 
এর জ্বলন্ত উদাহরণ আজকের খৃষ্টান ধর্ম। তারা ধর্মে বিদ‘আত প্রচলন করতে করতে উহার মূল কাঠামো পরিবর্তন করে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে পথভ্রষ্ট হিসাবে অভিহিত হয়েছে। তাদের বিদ‘আত প্রচলনের কথা আল-কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছেঃ 
وَرَهْبَانِيَّةً ابْتَدَعُوهَا مَا كَتَبْنَاهَا عَلَيْهِمْ إِلَّا ابْتِغَاءَ رِضْوَانِ اللَّهِ (سورةالحديد: ২৭) 
অর্থঃ আর সন্ন্যাসবাদ! ইহাতো তারা নিজেরাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় প্রচলন করেছিল। আমি তাদের এ বিধান দেইনি। (সূরা হাদীদ. ২৭) 
সন্ন্যাস তথা বৈরাগ্যবাদের বিদ‘আত খৃষ্টানেরা তাদের ধর্মে প্রবর্তন করেছে। তাদের উদ্দেশ্য ভাল ছিল; উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি। কিন্তু ভাল উদ্দেশ্য নিয়ে নিজেদের ইচ্ছামত যে কোন কাজ করলেই তা গ্রহণযোগ্য হয় না। এ জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুমোদন প্রয়োজন। এভাবে যারা ধর্মে বিদ‘আতের প্রচলন করে তাদের অনেকেরই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ভাল থাকে। কিন্তু তাতে নাজাত পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। ইয়াহুদী ও খৃষ্টানেরা তাদের ধর্মে অন্য জাতির রসম-রেওয়াজ ও বিদ‘আত প্রচলন করে ধর্মকে এমন বিকৃত করেছে যে, তাদের নবীগণ যদি আবার পৃথিবীতে ফিরে আসেন তাহলে তাদের রেখে যাওয়া ধর্ম তাঁরা নিজেরাই চিনতে পারবেন না। 
আমাদের মুসলিম সমাজে শিয়া সম্প্রদায় বিদ‘আতের প্রচলন করে দ্বীন ইসলামকে কিভাবে বিকৃত করেছে তা নতুন করে বর্ণনা করার প্রয়োজন নেই। 
(৪) বিদ‘আত ইসলামের উপর একটি আঘাত। 
যে ইসলামে কোন বিদ‘আতের প্রচলন করল সে মূলতঃ অজ্ঞ লোকদের মত এ কথা স্বীকার করে নিল যে, ইসলাম পরিপূর্ণ জীবন বিধান নয়, তাতে সংযোজনের প্রয়োজন আছে। যদিও সে মুখে এ ধরনের বক্তব্য দেয় না, কিন্তু তার কাজ এ কথার স্বাক্ষী দেয়। অথচ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম। (সূরা মায়িদা, ৩) 
(৫) বিদ‘আত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরুদ্ধে খিয়ানাতের এক ধরনের অভিযোগ। 
যে ব্যক্তি কোন বিদ‘আতের প্রচলন করল বা ‘আমল করল আপনি তাকে জিজ্ঞেস করুন “এ কথা বা কাজটি যে ইসলাম ধর্মে পছন্দের বিষয় এটা কি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানতেন? তিনি উত্তরে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ বলবেন। যদি ‘না’ বলেন তাহলে তিনি স্বীকার করে নিলেন যে, ইসলাম সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কম জানতেন। আর যদি ‘হ্যাঁ’ বলেন তাহলে তিনি স্বীকার করে নিলেন যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিষয়টি জানতেন, কিন্তু উম্মাতের মধ্যে প্রচার করেননি। এ অবস্থায় তিনি তাবলীগে শিথিলতা করেছেন। (নাউ‘যুবিল্লাহ!) 
(৬) বিদ‘আত মুসলিম উম্মাহকে বিভক্ত করে ও ঐক্য সংহতিতে আঘাত করে। 
বিদ‘আত মুসলিম উম্মাহর মধ্যে শত্র“তা ও বিবাদ-বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে তাদের মারামারি হানাহানিতে লিপ্ত করে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, একদল লোক মীলাদ বা মীলাদুন্নবী পালন করল। আরেক দল বিদ‘আত হওয়ায় তা বর্জন বা বিরোধিতা করল। যারা এটা পালন করল তারা প্রচার করতে লাগল যে, অমুক দল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিনে আনন্দিত হওয়া পছন্দ করে না। তাঁর গুণ-গান করা তাদের কাছে ভাল লাগেনা। তাদের অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বত নেই। যাদের অন্তরে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুহাব্বত নেই তারা বেঈমান, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুশমন। আর এ ধরনের প্রচারনায় তারা দুটি দলে বিভক্ত হয়ে একে অপরের দুশমনে পরিণত হয়ে হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ল। 
এভাবে ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই বিদ‘আতকে গ্রহণ ও বর্জনের প্রশ্নে মুসলিম উম্মাহ শিয়া ও সুন্নী এবং পরবর্তী কালে আরো শত দলে বিভক্ত হয়ে গেল। কত প্রাণহানির ঘটনা ঘটল, রক্তপাত হল। 
তাই মুসলিম উম্মাহকে আবার একত্র করতে হলে সকলকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে আহ্বান ও বিদ‘আত বর্জনের জন্য অহিংস ও শান্তিপূর্ণ পন্থায় পরম ধৈর্যের সাথে আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলন করতে হবে সকল মানুষ ও মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা প্রদর্শন করে । কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন আচরণ করা যাবে না। এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, যা হক ও সত্য তা-ই শুধু টিকে থাকবে। আর যা বাতিল তা দেরীতে হলেও বিলুপ্ত হবে। 
(৭) বিদ‘আত ‘আমলকারীর তাওবা করার সুযোগ হয় না। 
বিদ‘আত যিনি প্রচলন করেন বা সেই অনুযায়ী ‘আমল করেন তিনি এটাকে এক মহৎ কাজ বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন এ কাজে আল্লাহ তা‘আলা সন্তুষ্ট হবেন। যেমন আল্লাহ খৃষ্টানদের সম্পর্কে বলেছেন তারা ধর্মে বৈরাগ্যবাদের বিদ‘আত চালু করেছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। যেহেতু বিদ‘আতে লিপ্ত ব্যক্তি বিদ‘আতকে পাপের কাজ মনে করেন না, তাই তিনি এ কাজ থেকে তাওবা করার প্রয়োজন মনে করেন না এবং তাওবা করার সুযোগও হয় না। অন্যান্য পাপের বেলায় কমপক্ষে যিনি পাপে লিপ্ত হন তিনি এটাকে অন্যায় মনে করেই করেন। পরবর্তীতে তার অনুশোচনা আসে, এক সময় তাওবা করে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষমা লাভ করেন। কিন্তু বিদ‘আতে লিপ্ত ব্যক্তির এ অবস্থা কখনো হয় না। 
(৮) বিদ‘আত প্রচলনকারী রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফাআত পাবে না। 
রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর গুনাহগার উম্মাতের শাফায়াতের ব্যাপারে হাশরের ময়দানে খুব আগ্রহী হবেন । আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে অনুমতি লাভ করার পর তিনি বহু গুনাহগার বান্দা-যাদের জন্য শাফাআত করতে আল্লাহ তা‘আলা অনুমতি দিবেন-তাদের জন্য শাফাআত করবেন। কিন্তু বিদ‘আত প্রচলনকারীর জন্য তিনি শাফাআত করবেন না। 
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ 
ألا وإني فرطكم على الحوض وأكاثر بكم الأمم فلا تسودوا وجهي، ألا وإني مستنقذ أناسا ومستنقذ مني أناس، فأقول يا رب أصيحابي! فيقول إنك لا تدري ما أحدثوا بعدك. (رواه ابن ماجه، وصححه الألباني في صحيح سنن ابن ماجه
অর্থঃ শুনে রেখ! হাউজে কাউছারের কাছে তোমাদের সাথে আমার দেখা হবে। তোমাদের সংখ্যার আধিক্য নিয়ে আমি গর্ব করব। সেই দিন তোমরা আমার চেহারা মলিন করে দিওনা। জেনে রেখ! আমি সেদিন অনেক মানুষকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করার চেষ্টা চালাব। কিন্তু তাদের অনেককে আমার থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হবে। আমি বলবঃ হে আমার প্রতিপালক! তারা তো আমার প্রিয় সাথী-সংগী, আমার অনুসারী। কেন তাদের দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে? তিনি উত্তর দিবেনঃ আপনি জানেন না যে, আপনার চলে আসার পর তারা ধর্মের মধ্যে কি কি নতুন বিষয় আবিস্কার করেছে। (ইবনে মাজাহ) 
অন্য এক বর্ণনায় আছে এর পর আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই তাদের উদ্দেশে বলবেনঃ দূর হও! দূর হও!! 
(৯) বিদ‘আত মুসলিম সমাজে কুরআন ও হাদীসের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়। 
কুরআন ও সুন্নাহ হল মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামের রক্ষা কবচ। ইসলাম ধর্মের অস্তিত্বের একমাত্র উপাদান। তাইতো বিদায় হজ্বেও নবী কারীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমি তোমাদের জন্য দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যতক্ষণ তোমরা তা আঁকড়ে রাখবে ততক্ষণ বিভ্রান্ত হবে না। 
বিদ‘আত অনুযায়ী ‘আমল করলে কুরআন ও সুন্নাহর মর্যাদা মানুষের অন্তর থেকে কমে যায়। ‘যে কোন নেক ‘আমল কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে’ - এ অনুভূতি মানুষের অন্তর থেকে ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। তারা কুরআন ও হাদীসের উদ্ধৃতি বাদ দিয়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, পীর-মাশায়েখ ও ইমামদের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে। 
(১০) বিদ‘আত প্রচলনকারী অহংকারের দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ে ও নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে দ্বীনকে ব্যবহার ও বিকৃত করতে চেষ্টা করে। 
বিদ‘আত প্রচলনকারী তার নিজ দলের একটি আলাদা কাঠামো দাঁড় করিয়ে ব্যবসায়িক বা আর্থিক সুবিধা লাভের জন্য এমন কাজের প্রচলন করে থাকে যা সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় রূপ লাভ করলেও কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত হয় না। কারণ সেই কাজটা যদি কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা সমর্থিত হয় তাহলে তার দলের আলাদা কোন বৈশিষ্ট থাকে না। কেননা কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত ‘আমল সকল মুসলিমের জন্যই প্রযোজ্য। তাই সে এমন কিছু আবিস্কার করতে চায় যার মাধ্যমে তার দলের আলাদা পরিচয় প্রতিষ্ঠা করা যায়। 
এ অবস্থায় যখন হাক্কানী উলামায়ে কিরামগণ এর প্রতিবাদ করেন বা এ কাজটি চ্যালেঞ্জ করেন তখন তার ঔদ্ধত্য বেড়ে যায়। নিজেকে সে কুতুবুল আলম, ইমাম-সম্রাট, হাদীয়ে উম্মাত, রাহবারে মিল্লাত, যিল্লুর রহমান বলে দাবী করতে থাকে। প্রচার করতে থাকে এ দুনিয়ায় সে’ই একমাত্র হক পথে আছে, বাকী সবাই ভ্রান্ত। 

সন্দেহজনক নফল ‘আমল থেকে দূরে থাকা উত্তম 
যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে, শবে বরাত শর’য়ীভাবে প্রমাণিত, তাহলে উহার মর্যাদা কতটুকু হবে? বেশী হলে মুস্তাহাব। কেহ যদি সারা জীবন মুস্তাহাব শবে বরাতটা বর্জন করে তাহলে তার কি ক্ষতি হবে? 
কিন্তু যদি এটা বিদ‘আত হয়, আর যারা এর দিকে মানুষকে আহ্বান করল, উৎসাহিত করল, মানুষকে বিভ্রান্ত হতে প্ররোচিত করল, আকীদা-বিশ্বাসে বিকৃতি ঘটালো, এর প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রাখল তাহলে তাদের পরিণাম কি হবে? একটু ভেবে দেখবেন কি? 
ফিকাহর মূলনীতিতে একটি কথা আছে, “নতীজা আরজালের তাবে হয়” অন্যভাবে বলা যায়ঃ 
دفع المضر أقدم من جلب المنافع
অর্থাৎ একটা বিষয় লাভ ও ক্ষতি উভয়ের সম্ভাবনা থাকলে ক্ষতির বিষয়টি প্রাধান্য পাবে এবং বিবেচনায় আনা হবে। 
হাদীসে এসেছেঃ 
عن أبي عبد الله النعمان بن بشير رضي الله عنهما قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: إن الحلال بين وإن الحرام بين وبينهما أمور مشتبهات لا يعلمهن كثير من الناس، فمن اتقى الشبهات فقد استبرأ لدينه وعرضه، ومن وقع في الشبهات وقع في الحرام، كالراعي يرعى حول الحمى يوشك أن يرتع فيه، ألا وإن لكل ملك حمى، ألا وإن حمى الله محارمه. (رواه البخاري ومسلم
অর্থঃ আবূ আব্দুল্লাহ নুমান ইবনে বাশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে শুনেছিঃ নিশ্চয়ই হালাল স্পষ্ট করে বলা হয়েছে ও হারাম পরিস্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আর এ দুটোর মাঝে কিছু সন্দেহজনক বিষয় আছে যা অনেক মানুষই জানে না। সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহজনক বিষয় থেকে বেঁচে থাকল সে নিজের দ্বীন ও ইয্যাত আবরুকে বাঁচাল। আর যে সন্দেহজনক বিষয়ে লিপ্ত হয় সে প্রকারান্তরে হারামে লিপ্ত হয়ে পড়ল। যেমন কোন রাখাল যদি তার গবাদিপশু নিষিদ্ধ চারণভূমির পাশে নিয়ে যায় তাহলে তার অচিরেই নিষিদ্ধ চারণভূমিতে ঢুকে যাওয়ার আশংকা থাকে। তোমরা সাবধানতা অবলম্বন কর! প্রত্যেক রাজা-বাদশার সংরক্ষিত এলাকা রয়েছে, আর আল্লাহ তা‘আলার সংরক্ষিত এলাকা হল তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়সমুহ। (বুখারী ও মুসলিম) 

সর্বশেষ আহ্বান 
উপরোক্ত আলোচনার শেষ কথা হল, শবে বরাত একটি বিদ‘আতী পর্ব। অতএব আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম হলাম যেঃ 
(১) এ রাতকে কেন্দ্র করে কোন ধরনের ‘আমল করার সমর্থনে কোন সহীহ হাদীস নেই।
(২) এ রাত সম্পর্কে যা কিছু আকীদাহ বিশ্বাস প্রচলিত আছে তা পোষণ করা জায়েয নয়। 
(৩) এ রাতে ইবাদাত বন্দেগী করলে সৌভাগ্য খুলে যায় এমন ধারণা একটি বাতিল আকীদাহ। 
(৪) এ রাতে হায়াত, মউত ও রিয্ক বন্টনের বিষয় লেখা হয় বলে যে বিশ্বাস তা কুরআন ও হাদীসের বিরোধী। তাই তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে। 
(৫) এ রাতকে কেন্দ্র করে যেমন সম্মিলিতভাবে ইবাদাত বন্দেগী করা, রাত্রি জাগরণ করা ঠিক নয় তেমনি ব্যক্তিগত ইবাদাত বন্দেগী করাও ঠিক হবে না। তবে নিয়ম বা রুটিন মাফিক ইবাদাত বন্দেগীর কথা আলাদা। যেমন কেহ সপ্তাহের দু দিন রাত্রি জাগরণ করে থাকে। ঘটনাচক্রে এ রাত সেদিনের মধ্যে পড়লে অসুবিধা নেই। কিন্তু এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করলে অধিক সওয়াব হবে এমন ধারণায় ব্যক্তিগতভাবে বা চুপিসারে কিছু করাও ঠিক হবে না। 
(৬) ১৫ শাবানের রাতই দ‘ুআ কবূলের রাত নয়। বরং প্রতি রাতের শেষ অংশ দু‘আ কবূলের সময়। 
(৭) শুধু ১৫ শাবানের রাতেই আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন প্রথম আকাশে অবতরণ করেন না, বরং প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে তিনি প্রথম আকাশে অবতরণ করে বান্দাদেরকে তাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য প্রার্থনা করতে আহ্বান জানান। 
(৮) শবে বরাতের ‘আমল সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসগুলো কোনটা জাল, আবার কোনটা যয়ীফ বা দুর্বলসূত্রের। 
সম্মানিত পাঠকবৃন্দ! একটি বিষয় আপনারা অবশ্যই খেয়াল করে থাকবেন যে, মুসলিম উম্মাহর মধ্যে যত ফিরকা বন্দী, দলাদলি ও অনৈক্যের জন্ম হয়েছে উহার প্রায় সবগুলোই কিন্তু বিদ‘আত চালু করাকে কেন্দ্র করে হয়েছে। 
একদল লোক কোন একটা বিদ‘আতী কাজের ‘আমল শুরু করে দিল, অন্য একদল আলেম তার প্রতিবাদ করলেন। ব্যাস শুরু হল ফিরকাবাজী; শেষ পর্যন্ত মারামারি খুনাখুনি। অতঃপর ঐ বিদ‘আত-পন্থীদের আক্রোশ আরো বেড়ে গেল। তারা এ কাজটাকে তাদের দলের শ্লোগানে পরিণত করল। এরপর তারা এ তরবারি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করে মুসলিম উম্মাহর সুদৃঢ় বন্ধনকে রক্তাক্ত করতে থাকল। মুসলিমগণ হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে পড়ল। কেন তারা আল্লাহ তা’আলার হুকুমের প্রতি একটু খেয়াল করে না যেখানে তিনি বলেছেনঃ 
فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا 
(سورة النساء : ৫৯) 
অর্থঃ কোন বিষয়ে তোমাদের মধ্যে মতভেদ হলে তা উপস্থাপিত কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নিকট। এটাই উত্তম ও পরিণামে উৎকৃষ্টতর। (সূরা নিসা, ৫৯) 
অতএব এ রাত উদযাপন করা থেকে মানুষদেরকে নিষেধ করতে হবে। যে কোন ধরনের বিদ‘আতী কাজ থেকে মানুষকে সাধ্যমত বিরত রাখা ‘আল-আমর বিল-মারূফ ওয়ান নাহয়ি আনিল মুনকার’ এর অন্তর্ভুক্ত। 
আর এ বিষয়ে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা পালন করতে পারেন মুহতারাম উলামায়ে কিরাম, শ্রদ্ধেয় আইয়েম্মায়ে মাসাজিদ, দায়ী‘গণ ও ইসলামী আন্দোলনে শরীক ব্যক্তিবর্গ। 
সমস্ত প্রশংসা উভয় জাহানের মালিক আল্লাহর। তাঁর রাহমাত বর্ষিত হোক তাঁর রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর, তাঁর (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের) পরিবারবর্গ এবং সাহাবীগণের (রাঃ) উপর। আমীন!!! ওয়া আখিরুদ দাওয়ানা আনিল হামদুলিল্লাহি রাব্বিল ‘আলামিন। 
এ আহ্বান রেখে এবং মহান রাব্বুল আলামীনের কাছে সকল ব্যাপারে সকল ঈমানদারদের জন্য সত্য-সঠিক পথের দিশা প্রার্থনা করে শেষ করছি। 

الحمد الله تمت بالخير 


প্রমাণপঞ্জী 

صحيح البخاري  সহীহ আল-বুখারী 
صحيح مسلم  সহীহ মুসলিম 
سنن الترمذي  সুনানে তিরমিযী 
تفسيرالقرآن العظيم لابن كثير رحمه الله  তাফসীরে ইবনে কাসীর 
تفسير القرطبي  তাফসীরে কুরতুবী 
معارف القرآن لمفتي محمد شفيع رحمه الله  মায়ারেফুল কুরআন 
صحيح الجامع للشيخ ناصر الدين الألباني رحمه الله সহীহ আল-জামে’ লিল আল-বানী (রহঃ) 
التحذير من البدع للشيخ عبد العزيز بن باز رحمه الله  আত-তাহজীর মিনাল বিদয়াহ- 
আবদুল আযীয বিন বায (রহঃ) 
الصراحة في ليلة البراءة للشيخ تقي عثماني  শবে বরাতের তত্ত্বকথা- 
আল্লামা তকী উসমানী 
الشرك والبدعة للشيخ أبي الحسن علي الندوي رحمه الله  র্শিক ও বিদ‘আত-
আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) 
شرح رياض الصالحين من كتاب سيد المرسلين للشيخ محمد بن صالح العثيمين  শারহি রিয়াজুস্ সালিহীন- শায়খ মোঃ বিন সালেহ আল-উসাইমীন (রহঃ) 
 قواعد معرفة البدع لمحمد بن حسين الجيزاني কাওয়ায়েদু মারেফাতিল বিদ‘আ- 
মুহাম্মাদ বিন হুসাইন আল জিযানী 
السنة والبدعة : محمد عبد الرحيم رحمه الله  সুন্নাত ও বিদ‘আত : মুহাঃ আব্দুর রহীম 
 الجامع لأحكام القرآن لأبي بكر الجصاص আল-জামে লিআহকামিল কুরআন : আল-জাসসাস 
صحيح البخاري  সহীহ আল-বুখারী 
 صحيح مسلم সহীহ মুসলিম 
سنن الترمذي  সুনানে তিরমিযী 
تفسير القرآن العظيم لابن كثير رحمه الله  তাফসীরে ইবনে কাসীর 
تفسير القرطبي  তাফসীরে কুরতুবী 
معارف القرآن لمفتي محمد شفيع رحمه الله  মায়ারেফুল কুরআন 
صحيح الجامع للشيخ ناصر الدين الألباني رحمه الله সহীহ আল-জামে’ লিল আল-বানী (রহঃ) 
التحذير من البدع للشيخ عبد العزيز بن باز رحمه الله  আত-তাহজীর মিনাল বিদয়াহ- 
আবদুল আযীয বিন বায (রহঃ) 
الصراحة في ليلة البراءة للشيخ تقي عثماني  শবে বরাতের তত্ত্বকথা- 
আল্লামা তকী উসমানী 
 الشرك والبدعة للشيخ أبي الحسن علي الندوي رحمه الله র্শিক ও বিদ‘আত-
আবুল হাসান আলী নদভী (রহঃ) 
شرح رياض الصالحين من كتاب سيد المرسلين للشيخ محمد بن صالح العثيمين  শারহি রিয়াজুস্ সালিহীন- শায়খ মোঃ বিন সালেহ আল-উসাইমীন (রহঃ) 
قواعد معرفة البدع لمحمد بن حسين الجيزاني  কাওয়ায়েদু মারেফাতিল বিদ‘আ- 
মুহাম্মাদ বিন হুসাইন আল জিযানী 
السنة والبدعة : محمد عبد الرحيم رحمه الله  সুন্নাত ও বিদ‘আত : মুহাঃ আব্দুর রহীম 
الجامع لأحكام القرآن لأبي بكر الجصاص  আল-জামে লিআহকামিল কুরআন : আল-জাসসাস

 

শবে বরাতঃ সঠিক দৃষ্টিকোণ - পর্ব -১

 

মন্তব্য করুন।

No comments found.

New comment