সহীহ বুখারীতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেনঃ
اللَّهَ يُحِبُّ الْعُطَاسَ، وَيَكْرَهُ التَّثَاؤُبَ. فَإِذَا عَطَسَ فَحَمِدَ اللَّهَ؛ فَحَقٌّ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ سَمِعَهُ أَنْ يُشَمِّتَهُ، وَأَمَّا التَّثَاؤُبُ؛ فَإِنَّمَا هُوَ مِنَ الشَّيْطَانِ فَلْيَرُدَّهُ مَا اسْتَطَاعَ، فَإِذَا قَالَ: هَا ضَحِكَ مِنْهُ الشَّيْطَانُ
নিশ্চয়ই আল্লাহ্ হাঁচি দেয়া পছন্দ করেন এবং হাই তোলা অপছন্দ করেন। সুতরাং তোমাদের কেউ যখন হাঁচি দিয়ে আলহামদু লিল্লাহ্ বলবেঃ তখন যে সকল মুসলমান তা শুনবে, তাদের প্রত্যেকের কর্তব্য হচ্ছে, ইয়ারহামুকাল্লাহ বলে তার জবাব দেয়া। আর হাই তোলা শয়তানের পক্ষ থেকে। তোমাদের কেউ যখন হাই তুলবে, তখন সে যেন সাধ্যানুযায়ী তা প্রতিহত করার চেষ্টা করে। কেননা তোমাদের কেউ যখন হাই তোলার সময় হা বলে আওয়াজ করে তখন তার এ কাজে শয়তান হাসে। সহীহ বুখারীতে আরও উল্লেখ আছে, তোমাদের কেউ যখন হাঁচি দিবে, তখন সে যেন বলে আলহামদু লিল্লাহ। তার ভাই বা সাথী (যে তা শুনবে সে) যেন বলে ইয়ারহামুকাল্লাহ। যখন হাঁচি দাতার উদ্দেশ্যে ইয়ারহাকামুল্লাহ্ বলবে, তখন হাঁচি দাতা যেন বলেঃ يهديكم الله ويصلح بالكم অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের হেদায়াত করুন এবং তোমাদের অবস্থা সংশোধন করুন।
অনুবাদকের সংযুক্তিঃ
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রঃ) খাত্তাবীর সূত্রে বর্ণনা করে বলেনঃ আল্লাহ্ তাআলা হাঁচিকে পছন্দ করেন ও ভালবাসেন। এর কারণ হল হাঁচির মাধ্যমে শরীর হালকা হয় এবং তাতে কর্মদ্যোগ সৃষ্টি হয়। এর মাধ্যমে এবাদতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তাই আল্লাহ্ তাআলা এটিকে ভালবাসেন। এ জন্যই আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া স্বরূপ হাঁচি দিয়ে আলহামদু লিল্লাহ বলার আদেশ করা হয়েছে। অপর পক্ষে হাই এর বিপরীত। প্রচুর খাদ্য গ্রহণের কারণে শরীরে জ্যাম সৃষ্টি হয়, শরীর ভারী হয়ে যায় এবং শরীরে অলসতা সৃষ্টি হয়। এর ফলশ্র“তিতে হাই আসে। পরিণামে এবাদতের প্রতি অনাগ্রহ দেখা দেয়। এ কারণেই আল্লাহ্ তাআলা হাইকে অপছন্দ করেন। শয়তানও এতে খুশী হয়। তাই হাস আসলে যথা সম্ভব হাত বা রুমাল দিয়ে তা আটকিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। সংযুক্তি এখানেই শেষ।
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ তোমাদের কেউ যদি হাঁচি দিয়ে আলহামদু লিল্লাহ বলে তখন তোমরা তার উত্তর দাও। সে যদি আলহামদু লিল্লাহ না বলে তাহলে তোমরা তার উত্তর দিওনা। সহীহ মুসলিমে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, এক মুসলিমের উপর অন্য মুসলিমের ছয়টি হক রয়েছে। যখন তুমি তার সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন তাকে সালাম দাও, যখন সে তোমাকে দাওয়াত দিবে তখন তার দাওয়াত গ্রহণ কর, তোমার কাছে উপদেশ চাইলে তাকে উপদেশ দাও, হাঁচি দিয়ে আলহামদু লিল্লাহ্ বললে তার জবাব দাও, কোন মুসলিম ভাই মারা গেলে তার জানাযায় শরীক হও এবং সে অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাও। তিরমিজীতে আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমার (রাঃ) হতে আর বর্ণিত হয়েছে যে, আমাদেরকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাঁচি দিয়ে الحمد لله على كل حال (সর্বাবস্থায় সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য) বলতে শিক্ষা দিয়েছেন। ইমাম মালেক নাফে থেকে আর নাফে আব্দুল্লাহ্ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তোমাদের কেউ দিলে যখন তাকে বলা হবে يرحمك الله (আল্লাহ্ তোমার উপর রহম করুন) তখন সে যেন বলে يرحمنا الله وإياكم ويغفر لنا ولكم অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলা আমাদের ও তোমাদের উপর রহম করুন এবং আমাদেরকে এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করুন।
এই অধ্যায়ের শুরুতে যেই হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, তাতে বুঝা যায় হাঁচির জবাব দেয়া ফরজে আইন। ইবনে আবু যাইদ এই মতকেই পছন্দ করেছেন। এই মতের বিরোধীও কিছু পাওয়া যাচ্ছে না।
হাঁচির উপকারিতঃ
হাঁচির মাধ্যমে হাঁচি দাতার জন্য বিরাট নেয়ামত অর্জিত হয়। এটি স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভাল। কারণ কেননা এর মাধ্যমে শরীরে আটকে পড়া ধোঁয়া ও গ্যাস বের হয়ে যায়, যা শরীরের জন্য উপকারী। হাঁচি দেয়ার পর শরীর স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরত যায়। তাই এই নেয়ামতটি অর্জিত হওয়ার জন্য আল্লাহর প্রশংসা করার বিধান নির্ধারিত হয়েছে। যমীনে ভূমিকম্প হলে তা যেমন কেঁপে উঠে তেমনই হাঁচির মাধ্যমে শরীরে ভূমি কম্পের সৃষ্টি হয়।
অনুবাদকের সংযুক্তিঃ
সমকালীন ডাক্তারগণ বলেনঃ হাই তোলার সময় মুখ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী পরিমাণ উন্মুক্ত হয় এবং প্রচন্ড বেগে বাতাস ভিতরের দিকে আসা-যাওয়া করে। অথচ নাকের ন্যায় বাতাস গ্রহণ ও বর্জনের জন্য মুখ প্রস্তুত সব সময় প্রস্তুত থাকে না, মুখের মূল কাজও এটি নয়। তাই হাই তোলার সময় যখন মুখের স্বাভাবিক অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যায় এবং স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী পরিমাণ খুলে যায় তাই বাতাসের সাথে বিভিন্ন প্রকার রোগ জীবাণো, ময়লা এবং ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ প্রবেশের সম্ভাবনা থাকে। এ জন্যই পবিত্র সুন্নাতে হাই তোলার সময় মুখ ঢেকে রাখতে বলা হয়েছে। হাঁচি এর বিপরীত। এর মাধ্যমে মুখ ও নাক দিয়ে শ্বসযন্ত্র থেকে প্রচন্ড বেগে বাতাস বের হয়ে যায়। সেই সাথে শ্বাসযন্ত্রে প্রবেশকারী ধোলাবালি, ময়লা এবং বিভিন্ন রোগের জীবাণো বের হয়ে যায় এবং শরীর পরস্কিার হয়। তাই এটি আল্লাহর পক্ষ হতে হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কারণ এতে শরীরের উপকার রয়েছে। অপর পক্ষে হাই শয়তানের পক্ষ থেকে আসে বলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এ জন্যই সাধ্যানুযায়ী তা ঠেকাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সংযুক্তি এখানেই শেষ।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন হাঁচি দিতেন তখন মুখে হাত অথবা কাপড় রাখতেন এবং আওয়াজ নীচু রাখার চেষ্টা করতেন। তাঁর থেকে আরও বর্ণনা করা হয় যে, উঁচু আওয়াজের হাই এবং হাঁচি শয়তানের পক্ষ হতে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, এক ব্যক্তি তাঁর সামনে হাঁচি দিল। তিনি ইয়ারহামুকাল্লাহ বললেন। সে পুনরায় হাঁচি দিল। তখন তিনি বললেনঃ লোকটির ঠান্ডা (সর্দি) লেগেছে। মুসলিম শরীফে হাদীছটি এই শব্দেই বর্ণিত হয়েছে। তিরমিজীর বর্ণনায় এসেছে, তিনি তৃতীয়বার হাঁচি দিলে কথাটি বলেছেন। ইমাম তিরমিজী হাদীছটি বর্ণনার পর সহীহ বলেছেন। আবু দাউদ শরীফে আবু হুরাযরা (রাঃ) মাওকুফ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তুমি তিনবার তোমার ভাইয়ের হাঁচির জবাব দাও। এর বেশী হলে মনে করতে হলে সেটি হাঁচি নয়; ঠান্ডা ও সর্দি জণিত অসুখ।
যদি প্রশ্ন করা হয় যে, সর্দিতে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য তো আরও বেশী দুআর করা দরকার তাহলে উত্তর কি হবে? উত্তরে বলা হবে যে, রোগীর জন্য যেমন দুআ করা হয়, তার জন্যও অনুরূপ দুআ করতে হবে। আর যেই হাঁচি আল্লাহ্ পছন্দ করেন এবং যা নেয়ামত স্বরূপ তা সর্বোচ্চ তিনবার পর্যন্ত হতে পারে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণীঃ লোকটির সর্দি লেগেছে, এর উদ্দেশ্য হচ্ছে তার জন্য সুস্থতার দুআ করা জরুরী এবং এর মাধ্যমে জানা গেল যে, তিনবারের বেশী হাঁচি দিলে তার জবাব না দিলেও চলবে।
কেউ হাঁচি দিয়ে আলহামদু লিল্লাহ্ বললে কেউ যদি তা শুনে আর অন্যরা না শুনে তাহলে সঠিক কথা হচ্ছে আলহামদু লিল্লাহ বলার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলে হাঁচির জবাব দিতে হবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ সে যদি আলহামদু লিল্লাহ্ বলে তাহলে তার জবাব দাও। ইবনুল আরাবী বলেনঃ আর যদি আলহামদু লিল্লাহ বলতে ভুলে যায় তাহলে হাঁচি দাতাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবেনা। হাদীছের শব্দ এই মতকেই সমর্থন করে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ রকম পরিস্থিতিতে কাউকে স্মরণ করিয়ে দেন নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই সুন্নাতের উপর আমল করা এবং তা শিক্ষা দেয়ার পরও ভুলবশত আলহামদু লিল্লাহ্ পরিত্যাগকারীকে স্মরণ করিয়ে দেন নি।
সহীহ হাদীছের মাধ্যমে প্রমাণিত আছে যে, ইহুদীরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে এসে ইচ্ছা করেই হাঁচি দিত। এতে তাদের উদ্দেশ্য ছিল যাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের জবাবে يرحمكم الله বলেন। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা না বলে يهديكم الله ويصلح بالكم বলতেন। অর্থাৎ আল্লাহ তোমাদের হেদায়াত করুন এবং তোমাদের অবস্থা সংশোধন করুন।